ছবিতে যে-কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে দেখা যাচ্ছে তিনি আফ্রিকান। পেশায় অধ্যাপক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া প্রদেশের ‘জর্জিয়া গ্বিনেট কলেজ’- অধ্যাপনা করেন তিনি। তার নাম- রামাতা সিসোকো। জন্মভূমি- মালি। বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের ডক্টরেট ডিগ্রিধারী তিনি। বায়োলজিক্যাল সায়েন্স পড়ান তিনি, দুনিয়ার অন্যতম সেরা মেধাবী ছাত্রছাত্রীদেরকে।
ছবিটা ঘিরে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক, অধ্যাপিকা রামাতা পড়াচ্ছেন ক্লাসরুমে। তার পিঠের দিকে লক্ষ্য করেছেন আপনি ইতিমধ্যেই। হ্যাঁ, একটি শিশুকে তিনি পিঠে বেঁধে নিয়েছেন, ঠিক তার জন্মভূমির শিশুপালন সংস্কৃতিতেই। শিশুটি- ওই ক্লাসরুমেরই তার এক ছাত্রীর সন্তান। মায়ের সঙ্গে ক্লাসরুমে থাকা শিশুটি কাঁদছিলো। আফ্রিকার সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা ঐ শিক্ষিকা এ কান্না মেনে নিতে পারেননি। তিনিতো একজন মা। তাই, মার্কিনদেশে, অথচ মার্কিন-শিশুটিকে তিনি আগলে নিয়েছেন তার আফ্রিকান সংস্কৃতির রীতিতে।
ছবিটিকে কেন্দ্র করে গৌতম গুহ রায়ের লেখাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেটিজেনদের দৃষ্টি কেড়েছে। তিনি লিখেছেন, এই অমূল্য আচরণটি এতোই মুগ্ধ করেছিলো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদেরকে, এক ছাত্র বা ছাত্রী এই দৃশ্যের একটি ছবি তুলে ফেলেন। এটিই সেই ছবিটি। এবং, ছবিটি, দ্রুততার সঙ্গেই, ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল গণমাধ্যমগুলোতে। প্রত্যেকটি গণমাধ্যম এবং এই খবরের প্রত্যেক পাঠক ও দর্শক, আপাত ছোট্ট কিন্তু মূলত বিশাল ঘটনাটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়ে! কেন? কী আছে এই ঘটনাটায়?
সেদিন, সেই ক্লাসে, নিজের শিশুসন্তানকে নিয়েই প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিলো এক ছাত্রী; কারণ- কোনো বেবিসিটার (শিশুর দেখাশোনাকারী) পায়নি সে। শিশুটি কান্না করছিলো ক্লাস চলাকালীন পুরো সময়েই। প্রতিষ্ঠানটির নিয়মানুযায়ী, শিক্ষিকা রামাতা ছাত্রীমাকে তার ক্লাস থেকে সেদিনের জন্য অব্যাহতি দিতে পারতেন, বা শিশুটিকে ক্লাস চলা পর্যন্ত অন্যের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করতে পারতেন, বা আমাদের বাঙালি কতিপয় শিক্ষিকার অনুসরণে কয়েকটা বকাও দিতে পারতেন। কিন্তু, তিনি তা করেননি। তিনি শিশুটিকে নিজের কোলে তুলে নিলেন।
মুগ্ধকর ব্যাপার এটি নয়, মুগ্ধকর ও শিক্ষণীয় ব্যাপারটি হলো- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা রামাতা শিশুটিকে সেদেশের সংস্কৃতির রীতিতে কোলে বা কাঁধে না নিয়ে, একটুকরো কাপড় খুঁজে নিয়ে মায়াময় আদরে বেঁধে নিলেন নিজের পিঠে, ঠিক তার মাতৃভূমির ঐতিহ্যবাহী আফ্রিকান রীতিতে! এবং, মজার ব্যাপার হলো- এরপর, ছাত্রছাত্রীরা বিস্ময়ের সাথে দেখলো, ক্লাসটির পরবর্তী টানা তিন ঘণ্টা শিশুটি একটিবারের জন্যও কাঁদেনি আর! টুঁ শব্দও করেনি! স্রেফ আরামসে বসে রইলো সেই মাতৃপিঠে।
এই ছোট্ট ঘটনাটি কেন এমন আলোড়ন তুললো?
কারণটি গভীর। একজন প্রকৃত শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষ, যেকোনো স্থান-কাল-পরিস্থিতিতে, নিজ-দেশের সংস্কৃতি থেকে সরে যান না। এটি আমরা দেখেছি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত সব ব্যক্তিদের দ্বারা নিজ-সংস্কৃতির পোশাক, ভাষা, ইত্যাদির পরিবেশনা ও প্রয়োগে। অধ্যাপিকা রামাতা ঠিক সেটিই করলেন, আয়োজন করে নয়, স্বাভাবিক অভ্যাসেই। রামাতা, সেদিন, নিজের অজান্তেই, তার ছাত্রছাত্রীদেরকে, এমনকি বাকি পৃথিবীকেও, দু’টি আফ্রিকান সাংস্কৃতিক গুণ শিখিয়ে দিয়েছিলেন: সৌজন্যবোধ, এবং মাতৃত্বের রূপ।
সৌজন্যবোধ তিনি দেখিয়েছিলেন শিশুসহ ছাত্রীকে ক্লাসে প্রবেশ করতে দিয়ে, যে-শিশু শুরু থেকেই কান্না করছিলো। অন্য শিক্ষকরা হয়তো ছাত্রীটিকে ক্লাসে প্রবেশ করার অনুমতি না-ও দিতে পারতেন প্রতিষ্ঠানটির নিয়মানুযায়ী।
আর, মাতৃত্বের রূপময়তা? তিনি শিশুটিকে বয়ে বেড়িয়েছেন টানা তিন ঘণ্টা, পিঠে নিয়ে। এতে তিনি ক্লান্তি বোধ করেননি, এটি তার সংস্কৃতিরই একটি অংশ- শিশুকে শান্ত করে রাখার আফ্রিকান অতুলনীয় একটি রীতি। এবং, এটি তিনি এই রীতির প্রয়োগ করলেন উত্তর আমেরিকার আধুনিকতম একটি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে, অনেকের কাছেই এটি প্রয়োগ করা অস্বস্তিকর লাগতো।
বাকি পৃথিবীকে, এবং বাকি পৃথিবীতে, নিজ জাতি ও দেশের সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ধারণ করতে, সঙ্কোচবোধ কোরো না। নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলো না।