আল্লাহ লইয়া গেছে, কিচ্ছু করার নাই বলে কেঁদে দেয় জান্নাত

ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় মা বাবা সন্তানসহ তিনজন মারা যাওয়ার শোকে স্তব্ধ পরিবার একই সাথে ট্রাক চাপায় অন্তঃসত্ত্বা মায়ের পেট ফেটে নবজাতক বেঁচে যাওয়ার ঘটনাকে নজিরবিহীন বা অলৌকিক বলছে স্বজন ও প্রতিবেশীরা। কেউ কেউ বলছেন, এমন ঘটনা দেখা তো দুরে থাক। কেউ কোন দিন এমন ঘটনা শুনেননি।

রবিবার (১৭ জুলাই) সকালে ত্রিশাল উপজেলার রায়মণি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নিজ বাড়ি আঙ্গিনায় একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৪০), অস্তঃসত্ত্বা পুত্রবধু রত্না বেগম (৩০), নাতনী সানজিদার (৬) কবরের পাশে বসে বিলাপ করে কাঁদছেন বৃদ্ধ মা সুফিয়া বেগম। পাশেই বসে আছে বাবা মা বোন হারানো অপর দুই সন্তান এবাদত মিয়া (৮) ও মেয়ে জান্নাত আক্তার (১০)। আহাজারী দেখে স্তব্ধ এলাকাবাসী। কারোর মুখেই নেই যেন কোন কথা নেই। ওই এলাকার আনিস মিয়া বলেন,জাহাঙ্গীর আলম খুব ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি শ্রমিকের কাজ করতেন। গতকাল দুপুরের দিকে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্নাকে নিয়ে আল্টাসনোগ্রাফি করাতে ত্রিশালে যায়। এসময় তার সাথে যায় মেয়ে সানজিদাও।সেখানে গিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় ট্রাক চাপায় তিনজনই মারা যায়। তবে, ট্রাক চাপায় অন্তঃসত্ত্বা নারীর পেট ফেঁটে বাচ্চা হয়ে বেঁচে আছে, এটা নজিরবিহীন, অলৌকিক। আমার এই জীবনে এমন ঘটনা দেখেনি বা শুনিনি। তবে দোয়া করি ওই শিশু যেন বেঁচে থাকেন।

এবিষয়ে নিহত জাহাঙ্গীর আলমের ১০ বছরের মেয়ে জান্নাত আক্তার বিডি২৪লাইভ কে বলেন, আমার আব্বা আম্মারে নিয়ে আল্টাসনোগ্রাফি করাতে গেছিল। সেখানে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাক ধাক্কা দিলে আব্বা, আম্মা মরে গেছে। আমার একটা বোনও মাথায় আঘাত পেয়ে মরে গেছে। আমার আম্মার পেটে যে বাচ্চা ছিল। ওই আম্মার পেট ফুইট্টা বাইর হইয়া পড়ছে। সে এখনো বাঁইচ্চা আছে।

তোমার বাবা মা কোথায় জানতে চাইলে হাতের ইশারায় কবর দেখিয়ে দেয় জান্নাত। কাকে আব্বা ডাকবা জানতে চাইলে জান্নাত বলে, আমার আব্বা আম্মা মারা গেছে, কাদের আব্বা আম্মা ডাকব? আল্লাহ’র মাল আল্লাহ লইয়া গেছে, কিচ্ছু করার নাই বলে কেঁদে দেয় জান্নাত।

নিহত জাহাঙ্গীরের বোন মমতাজ আক্তার বিডি২৪লাইভ কে বলেন, ভাবি ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল না। সে ১০ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। ঈদের আগেই সন্তান প্রসব হওয়ার কথা ছিল। তবে, বাচ্চা প্রসব হচ্ছিল না। কোন সমস্যা হয়েছে কিনা জানার জন্য ত্রিশালে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে গিয়েছিল। তবে, আমার ভাই, ভাবী, ভাতিজী আর ফিরে আসল না। আমার দুই ভাতিজীকে যে এতিম করেছে। আমি তার কঠিন বিচার চাই।

নিহত জাহাঙ্গীর আলমের আত্মীয় হেলেনা বেগম আক্তার বিডি২৪লাইভ কে বলেন, ওই সড়কে তিনজনসহ গত ২০ বছরে আমার পরিবারের ৮ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তবে, আজও পর্যন্ত কোন বিচার পেলাম না। সঠিক বিচার পেলে হয়তো বারবার এমন ঘটনা ঘটনা ঘটতো না। এবারের ঘটনায় আমরা দোষীদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তি চাই।সেই গতকাল কাঁদছেন নিহত জাহাঙ্গীর আলমের বৃদ্ধ মা সুফিয়া বেগম। তিনি বলেন, আমার একমাত্র বুকের ধন স্ত্রী সন্তানসহ চিরতরে হারিয়ে গেছে। আমার বুকের ধন আপনারা ফিরিয়ে দেন বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বিডি২৪লাইভ কে বলেন, আমার এক মাত্র সন্তান ছিল জাহাঙ্গীর। ওই নবজাতকসহ জাহাঙ্গীরের তিন ছেলে মেয়ে রয়েছে। তিন জনের মাঝে ছেলেটা কিছুটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। আমি গরিব মানুষ, ছোট একটা চা’র দোকান করে আমার সংসার চলে। আমি ওই তিন সন্তানকে কিভাবে লালনপালন করব বুজতে পারছি না। সরকার যদি আমাকে সহায়তা না করে ওদের নিয়ে বেঁচে থাকাটা আমার জন্য কঠিন।

ত্রিশাল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আবু বকর সিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, এই ঘটনার পর নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোন অভিযোগ বা মামলা করতে কেউ আসেনি। তবে, ট্রাকটি থানা হেফাজতে আছে।এবিষয়ে জেলা প্রশাসক মো.এনামুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, খবর পেয়ে আমি ওই বাচ্চাটিকে দেখত হাসপাতালে গিয়েছিলাাম। সেখানে গিয়ে বাচ্চার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ ও ভবিষ্যতে যেন তার কোন সমস্যা না হয়। সেজন্য তার নামে একটি ব্যাংক একাউন্ট করে দেয়া হবে।এর আগে শনিবার (১৬ জুন) দুপুরের পরে উপজেলার রাইমনি গ্রামের ফকির বাড়ির মোস্তাফিজুর রহমান বাবলুর ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৪০), তার অস্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না বেগম (৩০), মেয়ে সানজিদাকে (৬) নিয়ে আল্টাসনোগ্রাফি করাতে ত্রিশালে আসেন। পৌর শহরের খান ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের সামনে রাস্তা পারাপারের সময় ময়মনসিংহগামী একটি ট্রাক তাদের চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই জাহাঙ্গীর আলম, স্ত্রী, রত্না বেগম মারা যায় এবং মেয়ে সানজিদা আক্তার গুরুতর আহত হয়। এসময় ট্রাক চাপায় রত্না বেগমের পেট ফেটে কন্যা শিশুর জন্ম হয়।

পরে আহত সানজিদা ও নবজাতককে নিয়ে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সানজিদাকে মৃত ঘোষণা করে নবজাতক বাচ্চাটিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। তবে, অতিরিক্ত যানজটের কারণে নবজাতককে চুরখাই কমিনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে সেখান থেকে চিকিৎসা দিয়ে ময়মনসিংহ মহনগরীর চরপাড়া এলাকায় লাবিব হাসপাতালে ভর্তি করেন। এদিকে, ওই দিন রাতে জানাজা শেষে উপজেলার রায়মণি এলাকার নিজ বাড়িতে পাশাপাশি তাদের দাফন করা হয়।