শ্রেণিকক্ষগুলো বানভাসি মানুষের জন্য খুলে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ, বরং স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষ ও বিশেষ দাতাদের সহযোগিতায় তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়। মাদরাসার রান্নাঘরে প্রস্তুত হয়েছে আশ্রয় গ্রহণকারী পরিবারের জন্য খাবার।
সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলায় চলছে ভয়াবহ বন্যা। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিশাহারা বানভাসি মানুষ। অসহায় ও বিপদগ্রস্ত এসব মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলা সদরে অবস্থিত জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া মারকাজুল উলূম। বন্যার পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করলে গত বৃহস্পতিবার থেকে এখানে আশ্রয় নিতে আরম্ভ করে স্থানীয় পরিবারগুলো।
পরিচালনা কমিটির অনুমোদন নিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের জন্য মাদরাসা ভবন খালি করে দেন অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুর রহমান কফিল। শেষ পর্যন্ত প্রায় দুই শ পরিবার এখানে আশ্রয় গ্রহণ করে। আশ্রয়দানে তিনি মুসলিম ও অমুসলিমে কোনো পার্থক্য করেননি। ধর্ম-মত-নির্বিশেষে সবাই এখানে আশ্রয় পেয়েছে।
হঠাৎ সৃষ্ট বন্যায় মাদরাসার নিজস্ব সংকট ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিতান্ত কম না হলেও সৃষ্টির সেবায় এগিয়ে আসতে কুণ্ঠাবোধ করেননি সমাজসেবক এই আলেম। মাওলানা আবদুর রহমান কফিল খিদমাহ ব্লাড ব্যাংকেরও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। সংগঠনটি রক্তদান কর্মসূচির বাইরেও সারা বছর নানা ধরনের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। চলমান বন্যার শুরু থেকে সংগঠনটি মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে আসছে।
বন্যায় মারকাজুল উলূম নিজেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। মাদরাসার অন্যতম আয়ের উৎস পুকুরের মাছ বন্যায় ভেসে গেছে। এই পুকুর থেকে মাদরাসা বছরে কয়েক লাখ টাকা উপার্জন করে। এ ছাড়া মাদরাসার নিচতলায় সংরক্ষিত ধান, যা থেকে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক খোরাকির ব্যবস্থা হয় তার কিছুটা নষ্ট হয়েছে।
এত সংকটের মধ্যেও কেন মাদরাসা মানুষের জন্য তার দুয়ার খুলে দিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা আবদুর রহমান কফিল বলেন, কেন করব না? এটাই তো ইসলামের শিক্ষা। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) মানবসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এ ছাড়া আমার বাবা মাওলানা গোলাম নবী যিনি ৪২ বছর এই মাদরাসার অধ্যক্ষ ছিলেন, তিনিও আমাকে মানুষের সেবা করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি ছিলেন অসহায় মানুষের আশ্রয়।
আশ্রয়প্রার্থীদের জায়গা করে দেওয়া কতটা কঠিন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজটা সহজ ছিল না। মাদরাসার পুকুরের মাছ ও ধান রক্ষার চ্যালেঞ্জ ছিল। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের আসবাবগুলো সরিয়ে খালি করতে হয়েছে। হঠাৎ করেই এই সংকটগুলো সামনে চলে আসে। এর পরও পরিচালনা কমিটি মাদরাসাকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করে সৎসাহসের পরিচয় দিয়েছে।
শ্রেণিকক্ষগুলো বানভাসি মানুষের জন্য খুলে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেনি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। বরং তাদের খাবারের জন্য যোগাযোগ করেছেন বিভিন্নজনের সঙ্গে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাধারণ মানুষ ও বিশেষ দাতাদের সহযোগিতায় তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়। মাদরাসার রান্নাঘরে প্রস্তুত হয়েছে আশ্রয় গ্রহণকারী পরিবারের জন্য খাবার। অবশ্য বন্যার পানি কমে যাওয়ায় এরই মধ্যে বেশ কিছু পরিবার নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছে।
মাদরাসায় আশ্রয় গ্রহণকারীদের একজন মাওলানা আলফাজুর রহমান। তিনি সপরিবারে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘আকস্মিক বন্যায় আমরা দিশাহারা হয়ে যাই। ভেবে পাচ্ছিলাম না কোথায় আশ্রয় নেব। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ যখন আমাকে সপরিবারে আশ্রয় দিলেন, তখন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারা আশ্রয় না দিলে হয়তো আমাদের আরো অনেক বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হতো। আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন। আমিন।