মসজিদের ইমাম, কমিটি বা নেতৃত্ব নিয়ে চারিদিকে যখন হানাহানির খবর, তখন ইমামকে নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন পাবনার মুসল্লিরা। রীতিমতো রাজকীয়ভাবে বিদায় জানালেন ৫৩ বছর ধরে ইমামতি করা ইমামকে। এই নজির স্থাপন করেছেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়নের যশমন্তদুলিয়া গ্রামের মুসল্লিরা।
ঈদের পরদিন গত ৪ মে (বুধবার) বিকেলে শতাধিক মোটরসাইকেল, সিএনজি এবং ঘোড়ার গাড়িতে বিশাল শোভাযাত্রা করে জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিদায় দেয়া হয়েছে যশমন্তদুলিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের প্রিয় ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা আবু মুসাকে। শুধু শোভযাত্রা নয়, তাকে ঘিরে পুরো গ্রামে কয়েকদিন ধরে নানা আয়োজন করা হয়। বিদায় বেলায় গ্রামের মানুষ ভালোবেসে নগদ ৩ লাখ টাকার হাদিয়া তুলেছেন। প্রায় ২০ হাজার টাকা দিয়ে একাধিক টাকার মালা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রায় প্রত্যেক বাড়ি থেকে পাঞ্জাবি, পায়জামা, টুপি, জুতা ও আসবাবপত্রসহ নানা সামগ্রি দেয়া হয়। ইমামের প্রতি গ্রামের এমন ভালোবাসার কারণে প্রশংসায় ভাসছেন এলাকাবাসী। নেট দুনিয়ায় ঘটনাটি ভাইরাল হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, কিশোর বয়সে সুজানগর উপজেলার তাঁতীবন্দ ইউনিয়নের বাড়ইপাড়া গ্রামের সন্তান হাফেজ আবু মুসা পার্শবর্তী উপজেলার যশমন্তদুলিয়া গ্রামের মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তখন মসজিদটি একেবারে জরাজীর্ণ ছিল। নামাজ আদায়ের তেমন উপযোগী ছিল না। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে মসজিদটির উন্নতি ঘটতে থাকে। জরাজীর্ণ মসজিদটি বড় ও উন্নত করেছেন। পাশাপাশি তিনি অবহেলিত এই এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন মাদ্রাসা, ঈদগাহ ও গোরস্থান। এছাড়াও তিনি আশপাশে আরও বেশ কয়েকটি মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তার নানা উদ্যোগ এলাকার মানুষের মন জয় করে নেন। এই ৫৩ বছরের মধ্যে তিনি গ্রামবাসীদের আত্মার সঙ্গে মিশে গেছেন।
গ্রামের মানুষ তাকে বিদায় দিতে না চাইলেও বার্ধক্যের কারণে তিনি বিদায় নিতে বাধ্য হোন। কিন্তু বিদায় বেদনার হলেও এলাকাবাসী তা কষ্টে মেনে নেন এবং তার সম্মানে যশমন্তদুলিয়া যুব সমাজের উদ্যোগে আয়োজন করেন রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনার। বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইমামকে দেয়া হয় ক্রেস্ট। পরে তাকে ঘোড়ার গাড়ির বহরে করে রাজকীয় অথচ চোখের জলে বিদায় দেওয়া হয়।
এ সময় এলাকার মুরুব্বিসহ সর্বস্তরের মানুষ প্রিয় ইমামকে ধরে গাড়িতে তুলে দেন এবং শতাধিক মোটরসাইকেল, সিএনজিসহ ঘোড়ার গাড়িতে করে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসেন। এ সময় সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। মসজিদের ইমাম কাম-খতিবের এমন রাজকীয় বিদায়ের ভিডিও এবং ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই তা ভাইরাল হয় এবং নেটিজেনসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসায় ভাসেন এলাকাবাসী।
মসজিদ কমিটির সভাপতি মইনউদ্দিন মাস্টার বলেন, মাওলানা আবু মুসা দীর্ঘ ৫৩ বছর তাদের মসজিদে ইমামতি ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে এখন বার্ধক্যে পৌঁছেন। তিনি আমাদের সবার সঙ্গে মিশে ছিলেন। গ্রামবাসী তার পরামর্শ নিয়ে কাজকর্ম করতেন। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবকের মতো। তাই তাকে বিদায় বেলায় এভাবে সম্মানিত করার চেষ্টা করেছি।
সাঁথিয়ার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনছুর আলম পিনচু বলেন, আমার ইউনিয়নের আজ পর্যন্ত এমন উদ্যোগ কেউ নেয়নি। এখন তো অনেক এলাকায় মসজিদের ইমাম নিয়োগ নিয়েও এখন মানুষ বিরোধ জড়াচ্ছেন। সেখানে একজন ইমামকে এভাবে বিদায় দেওয়া একটি ঐতিহাসিক বিদায় বলে মনে করি। সারা দেশের মধ্যে এটা অনূকরণীয় হয়ে থাকবে।