ক্রেতা হীন নিউমার্কেট যখন যুদ্ধের ময়দান

দ্বিতীয় দফায় রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষের এক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অন্য সময় ব্যস্ততম নিউমার্কেট ক্রেতা-বিক্রেতায় লোকারন্য হয়ে থাকত, সেই নিউমার্কেট এখন ইট-পাটকেল, দেশি অস্ত্রে পরিপূর্ণ এক রণক্ষেত্র। মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে এমন থমথমে অবস্থা দেখা যায়। ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থী উভয়েরই রয়েছে পাল্টা অভিযোগ। ওই দিনে ভোরে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে এলে প্রেস ব্রিফিং করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশীদ।

সকাল গড়াতে না গড়াতে আবারো হামলা, পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। মুহুর্তেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় নিউমার্কেট। এসময় মিরপুর রোডের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে টিয়ার শেল, কাদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। তাই তারা ইট-পাটকেল ছুড়ছে। দেখা গেছে, ঢাকা কলেজের সু-উচ্চ ভবন থেকে পুলিশ ও ব্যবসায়ীদের দিকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোঁড়ার চিত্র।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের কারণে ওই এলাকার অন্তত ২০টি মার্কেটের দোকানপাট বন্ধ ছিল। এতে দিনে অন্তত ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের পাশে অবস্থান করে ছাত্রদের দিকে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। তবে এই ধরনের সংঘর্ষের ক্ষেত্রে অন্যান্য সময়ে যে ধরনের তৎপরতা দেখা দেয়, সে রকম তৎপরতা দেখা যায়নি।

পুলিশের আসতে দেরি হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা জোনের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ আশপাশেই ছিল। তবে স্ট্র্যাটেজিক কারণে পুলিশ সামনে আসেনি।’ এই স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত কারণ কী সেটি অবশ্য স্পষ্ট করেননি তিনি। এদিকে নিউ মার্কেটে ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের সংঘর্ষের ঘটনায় আহতদের মধ্যে মো. নাহিদ (১৭) একজন মারা গেছেন। নাহিদ পেশায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি ম্যান ছিলেন। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘর্ষের এ ঘটনায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।

মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) রাত ৯টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল তার মৃত্যু হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আইসিইউতে কর্তৃব্যরত চিকিৎসক ডা. তৌফিক ইলাহী। এ দিকে ঢামেক (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৯ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।

দোকান পোড়ানোর অভিযোগ: শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দোকান পোড়ানোর অভিযোগ ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে তুলেছে ব্যবসায়ীরা। এদিকে শিক্ষার্থীরা বলছে, ওদের মধ্যে কলহের জের এই ইস্যুটি লক্ষ্য করে এমন কান্ড ঘটিয়েছে তাঁরা।

হল না ছাড়ার হুশিয়ার: ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনার পর আগামী ৫ মে পর্যন্ত হল বন্ধের ঘোষণা দেয় প্রশাসন। এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা যেকোনো মূল্যে হল-ক্যাম্পাসে অবস্থান করবেন। মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) বিকেল সোয়া চারটায় ঢাকা কলেজের শহীদ আ. ন. ম নজিব উদ্দিন খান খুররম অডিটোরিয়ামে সম্মিলিতভাবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যানের কথা জানান।

দিনভর সংঘর্ষের পর রাতে সড়ক ছেড়েছেন নিউমার্কেটের দোকানমালিক–কর্মচারী এবং ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনে থেকে উঠে শিক্ষার্থীরা কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যান। এ সময় ঢাকা কলেজের মূল ফটক আটকে দেওয়া হয়। এর আগে রাত সোয়া ১০টার দিকে দোকানমালিক ও কর্মচারীরা সড়ক ছেড়ে চলে যান। বুধবার (২০ এপ্রিল) থেকে ঈদ পর্যন্ত আমাদের ক্যাম্পাসের সামনে ও সামনের সড়কে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে নিশ্চিত করেন, ঢাকা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষার্থী আরো বলেন, আমাদের দাবি, নিউমার্কেট ও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস এলাকায় আর কোনো সন্ত্রাস–চাঁদাবাজি চলবে না, ব্যবসার নামে কোনো সন্ত্রাস চলবে না।

এর আগে, সোমবার (১৮ এপ্রিল) দিবাগত রাতে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মধ্যরাতে সংঘর্ষ থামলেও মঙ্গলবার (১৯ এপ্রিল) সকাল থেকে নিউমার্কেট এলাকা অবরোধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। এরপর সোয়া ১০টার দিকে আবারও শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে নিউমার্কেটের সকল দোকানপাট বন্ধের সঙ্গে সড়কের উভয় পাশে যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। বেলা গড়াতেই সংঘর্ষ রণক্ষেত্রে রূপ।

এদিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঢাকা কলেজের মাস্টার্সের দুই শিক্ষার্থী রাত ১২টার দিকে নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে যান। এ সময় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের কেনাকাটা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে দুই শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে যান ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবি, অর্ধেক দাম পণ্যের মূল্য পরিশোধ নিয়ে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে তাঁরা হামলা চালায়।