সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে হাওরে এক ফসলি বোরো ধান হারিয়ে কৃষকদের মধ্যে হাহাকার বাড়ছেই। অন্যদিকে বাড়ছে বাঁধ ভেঙে ফসল ডুবির পরিমাণও। এদিকে, পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত থাকায় যে বাঁধগুলো এখনও টিকে আছে সে বাঁধেও ধস ও ফাটল দেখা দেওয়ায় ঝুঁকির মুখে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় হাজার হাজার কৃষক।
এ অবস্থায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বিরাজ করছে এলাকাজুড়ে। অনেকেইে কাঁচা ও আধাপাকা ধান কাটছে ডুবে যাওয়া হাওরগুলোর কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। অন্যদিকে শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটতে না পাড়ায় চোখের সামনেই বোরো ফসল তলিয়ে যাচ্ছে।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যেসব কৃষকের কাছে নগদ অর্থ রয়েছে তারা শ্রমিকদের দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিয়ে ধান কাটাচ্ছেন। আবার অর্থের অভাবে অনেকেই এক মণ ধানের দামেও মিলাতে পারছে না শ্রমিক। যার ফলে চোখের সামনেই ফসল হারিয়ে দিশেহারা হাওরপারের কৃষকরা। আর পিআইসির নামে প্রভাবশালীরা প্রকল্প নিয়ে সরকারি টাকা লুটপাট করেছে এমন অভিযোগের পাহাড় এখন হাওরাঞ্চলের সর্বত্রই।
হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ করায় প্রতিটি বাঁধেই দুর্বল হয়েছে, এ কারণেই হাওরে পাহাড়ি ঢলে একের পর এক হাওরের বাঁধ ভেঙেছে। এই ক্ষতির দায় পাউবোকেই নিতে হবে বলে জানান হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, গত শনিবার (২ এপ্রিল) প্রথমে তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের নজরখালী বাঁধ ভেঙে বোরো ফসল তলিয়ে যায়। এরপর একে একে টাঙ্গুয়ার হাওরের এলারিয়া কোনা হাওর, লতিবপুর হাওর এবং সর্বশেষ সোমবার (১৮,০৪,২০২২) পর্যন্ত বাঘামারা, জিনাউড়া হাওরসহ ৬টি হাওরের অন্তত ৮ হাজার হেক্টরের অধিক কাঁচা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে দাবি কৃষকদের। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। টিকে থাকা বাঁধগুলোতে রাত জেগে বাঁধ পাহারা দিচ্ছেন হাওরপারের বাসিন্দারা ও প্রশাসন।
পানি উন্নয়ন বোডের্র (পাউবো) কর্মকর্তা বলছেন, গত এক সপ্তাহ ধরে উজানের (ভারতের চেরাপুঞ্জি) বৃষ্টিই ভয়ের মুল কারণ। অস্বাভাবিকভাবে পানি বাড়ায় ঝুঁকিতে পড়ে জেলার সব হাওরের বোরো ফসল।
উপজেলার শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের কৃষক আল আমিন মিয়া বলেন, টাংগুয়ার হাওরে অনেক আশা নিয়ে ৮-১০কেয়ার জমিতে বোর ধান রোপণ করেছিলাম। ঈদের ছেলেমেয়েদের নতুন কাপড় কিনে দিব। সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনব কিন্তু হঠাৎ বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ধান কাটতে গতকাল থেকে শ্রমিকের জন্য ছোটাছুটি করে পার্শ্ববর্তী উত্তর বড়দল ইউনিয়ন হতে ৭-৮ জন শ্রমিক নিয়ে আসলেও আসতে আসতে সব ধান তলিয়ে গেছে, দুই এক কিয়ার ধান কাটতে পেরেছি। এখন আমি দিশেহারা কিভাবে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।
একই গ্রামের নুর উদ্দিন মিয়া বলেন,গেল দুই সপ্তাহ ধরে উপজেলা প্রশাসনসহ আমরা বাঁধ রক্ষায় লড়াই করছিলাম ধান কাটার সুযোগ পাইনি। বর্তমানে শ্রমিক সংকটের কারণে চোখের সামনেই তলিয়ে যাচ্ছে আমার একমাত্র ফসল ৭-৬জন শ্রমিক অন্য এলাকা হতে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিয়ে এনে দুই কিয়ার (৬ শতাংশ) কাটলেও ১০-১২ কিয়ার জমি চোখের সামনেই তলিয়ে গেছে। এবার ঈদে নতুন কাপড় কিভাবে কিনব জানি না।
হাওরাঞ্চলে কৃষক ও কৃষির সাথে সম্পর্কিতরা অভিযোগ করেন,সঠিক তদারকির অভাবে কাজে অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ এবারও প্রমাণিত হয়েছে। ঠিকাদারের পর পিআইসি ও কার্যত ব্যথ। অনেক জায়গায় অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের ফলে উল্টো হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। আর এসব পিআইসি গঠনেও বেশির ভাগেই রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিজস্ব লোক।
মাটিয়ার হাওরের কৃষক হাবিবুর রহমান খেলু ও কৃষক ও কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজন বলছেন,হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে অর্থ বরাদ্দ বহুগুণ বেড়েছে। বেড়েছে বাঁধের দৈর্ঘ্য ও উচ্চতাও। পিআইসি ও পাউবোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন এ বছরও হবে না। দুর্বল বাঁধ ও ক্লোজারে (খালে) যথাযথ নিয়মে কাজ না করার কারণেই হাওরে উৎপাদিত একমাত্র বোরো ধান এখন ঝুঁকিতে পড়েছে।
দক্ষিন শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আহমদ মোরাদ ও হাওর পাড়ের মানুষ ক্ষোব প্রকাশ কর বলছেন,দিনরাত হাওরের বাঁধ রক্ষা আমাদের কাজ করতে হয় কেন। হাওরের ব্যাপক ফসলহানির পুনরাবৃত্তি যে কোনো উপায়ে ঠেকাতে হবে। সেজন্য বাঁধ নির্মাণ-মেরামতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দুর্নীতি-অনিয়ম-অবহেলা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাসান উদ-দৌলা বলেন রবিবার (১৭ এপ্রিল) যেসব হাওরে পানি প্রবেশ করেছে সেসব হাওরে এ মৌসুমে ৫০০ হেক্টরের বোরো ধান রোপণ করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৩০০ হেক্টরের মতো ধান এ পর্যন্ত কাটতে পেরেছে এবং ২০০ হেক্টরের মতো ধান পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এ অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তথ্যসংগ্রহ হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সরকারের সহায়তার আওতায় আসবে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান কবীর বলেন, হটাৎ করে পানির চাপে গুরমার হাওরের বাঁধের এই অংশ ভেঙে গেছে। আমরা ক্ষতির পরিমাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করব। এখন হাওরের বোরো ফসল বাঁচাতে লামাগাঁও বাজার ও দুমাল গ্রামের মধ্যের বাঁধটিসহ বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ বাঁধগুলো আরো মজবুত করতে কাজ করছি।