নীলফামারীর জলঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল কুকরাদহ সীমান্তে এসেছেন কল্পনা রানী (৪০)। গত দুই বছর আগে পয়লা বৈশাখে এই সীমান্তে এসেই মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। এবারও স্বামী ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন কল্পনা রানী। মায়ের জন্য নিয়ে এসেছিলেন শাড়ি, গুড়-মুড়ি এবং রান্না করা পোলাও ও খাসির মাংস। তাঁর মা থাকেন ভারতের জলপাইগুড়িতে। কিন্তু সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের পক্ষ থেকে মিলনমেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) সকাল ১০টা থেকে বসে থাকতে থাকতে বেলা তিনটার দিকে চোখের পানি মুছতে মুছতে স্বজনদের নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। এভাবে পাশের জেলাগুলো থেকে আসা হাজার হাজার মানুষকে ফিরে যেতে হয়েছে। দুপুরে ওই সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিপুলসংখ্যক মানুষ নিরাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে। মাইকিং করে মিলনমেলা হবে না জানিয়ে সীমান্তের কাছাকাছি যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। ভারতের অনুমতি না থাকায় কোনো বাংলাদেশি যাতে সীমান্তের কাছাকাছি যেতে না পারেন, সে জন্য মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দুই বাংলার সীমান্তে লাখো মানুষের মিলনমেলা করা সম্ভব হয়নি এবার। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে কথা বলা আর দেখা না করার আক্ষেপ অধরা রয়ে গেল এক বছর অপেক্ষারত এপার ওপারে থাকা আত্মীয়স্বজনদের সাথে।
প্রতিবছরই এই মিলনমেলায় ভারতে থাকা আত্মীয়স্বজনের জন্য নানা উপহারসামগ্রী নিয়ে হাজির হন বাংলাদেশিরা। সেখানে কেউ কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে, কেউবা এপার থেকে ওপারে ছুড়ে আবার কেউবা লম্বা কোনো বাঁশ দিয়ে কাঁটাতারের ওপর দিয়ে উপহারসামগ্রী বিনিময় করেন। শুধু আবেগী এই দৃশ্য দেখার জন্যও অনেকে ছুটে আসেন এখানে। সীমান্তে বসে নানা উপহারসামগ্রীর দোকান। তবে এবার নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে দুই দেশে থাকা স্বজনদের।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস ও রমজান মাসের কারণে এবার সীমান্তের কাঁটাতারের কাছে কোন মানুষজনকে ভীড় জমাতে দেয়নি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী।
উপজেলা প্রশাসনের সূত্রে জানা যায়, নববর্ষ উপলক্ষে এসব সীমান্তে প্রতিবছর দুই বাংলার মিলন মেলা হয়ে থাকে। অনেকদিন পর আপনজনের দেখা পেয়ে কেঁদে বুক ভাসান দুই বাংলার বাঙালি। এসময় তারা বিনিময় করেন মনের জমানো হাজারও কথা।
জেলার হরিপুর ও রাণীশংকৈল উপজেলার তাজিগাঁও,জনগাঁ, বুজরুক, বেতনা, কোচল, কুকরাদহ, ডাবরী সীমান্তের শূন্য রেখায় দুই বাংলার এই মিলনমেলা বসে। ঠাকুরগাঁও ৩০-বিজিবি ব্যাটালিয়ান ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের উদ্যোগে এ মিলন মেলার আয়োজন করা হয়।
এদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হরিপুর ও রাণীশংকৈল উপজেলার সীমান্তের প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাংলাদেশ ও ভারতের হাজার হাজার মানুষের এই মিলনমেলা বসে।
মিলনমেলাকে কেন্দ্র করে উভয়দেশের সীমান্তে পর্যাপ্ত বিজিবি ও বিএসএফ মোতায়ন করা হয়। কঠোর পাহারায় কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে স্বজনদের একদৃষ্টি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লাখো মানুষের ঢল নামে। এই ক্ষণিক মিলনে অনেকেই আবেগ হয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা।
এবার আর কাঁটাতারের ওপারে থাকা আত্মীয়স্বজনরা মিলিত হতে পারনেনি। দিনাজপুর বীরগঞ্জ থেকে আসা থিতিলী রাণী (৪৫), হরি চাঁদ রায় (৩০) আমল (৪৭) সহ বিভিন্ন এলাকার অনেকে বলেন, সকাল থেকে আমরা ভারতীয় আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষায় রয়েছি। দুপুর গড়িয়ে বেলা শেষের দিকে তারপরেও দেথা করতে পারছিনা। আত্মীয়রা ওপারে অপেক্ষায় রয়েছে কাঁটাতারের কাছে আসতে পারছেনা। আগামী বছর দেখা করার অপেক্ষায় রইলাম ।
লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা বাজার এলাকা থেকে আসা আসমা বেগম বলেন, ভারতে ভাই-ভাবি বসবাস করেন। তাই তাদের সঙ্গে দেখা করতে এই কাঁটাতারের বেড়ার কাছে এসেছি। এখনো দেখা হয়নি, না দেখা করেই ফিরতে হবে এবার।
ঠাকুরগাঁওয়ের ভুল্লী থেকে আসা রামমোহন রায় বলেন, আমার ৫ মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে তিন মেয়েরই বিয়ে হয়েছে ভারতের চাউলহাটিতে। আজকে নববর্ষের দিনে সুযোগ হয়েছে তাই মেয়ে-জামাই আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ওদের জন্য কিছু কাপড়-চোপড় আর খাবার জিনিস নিয়ে এসেছি। কিন্তু মিলনমেলা না হওয়াই দেখা না করেই ফিরে যেতে হচ্ছে।
দিনাজপুরের বড়খাতা ইউনিয়ন থেকে ভারতে বসবাস করা ছেলেকে দেখতে এসেছিলেন বৃদ্ধা মধুবালা। তিনি কেঁদে কেঁদে জানালেন, টাকার অভাবে ভারতে যেতে পারি না, তাই খবর পেয়ে এলাম ছেলেকে দেখতে; না দেখেই ফিরে যাচ্ছি।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এই সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকে দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা হয়। এবার বিএসএফের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় এবার এ মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এবং কাঁটাতারের কাছে কোন বাংলাদেশীরা যেন না যায় সে বিষয়ে আমাদের অনুরোধ করেছেন তারা।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির আগে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অধীনে এসব সীমান্ত ছিল। বিভক্তির পর এসব এলাকা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। দেশ বিভাগের কারণে এখানকার অনেক পরিবার ও আত্মীয়স্বজন দুই দেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দুই দেশের নাগরিকেরা তাঁদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়া–আসার সীমিত সুযোগ পেলেও ভারত তাদের সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করায় সে সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে উভয় দেশের নাগরিকদের অনুরোধে প্রায় এক যুগ ধরে বিজিবি ও বিএসএফের সহযোগিতায় এসব সীমান্তে দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
রাণীশংকৈল উপজেলা চেয়ারম্যান শাহরিয়ার আজম মুন্না বলেন, উপজেলার অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির আগে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অধীনে ছিল। এ কারণে দেশ বিভাগের পর আত্মীয় স্বজনেরা দুই দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সারাবছর এদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে না। অপেক্ষা করে থাকে এই দিনের। দুই দেশের ভৌগলিক সীমারেখা আলাদা করা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে।
সাধারণ মানুষসহ নানা পেশার মানুষ এ মিলন মেলায় এসে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারায় আনন্দিত হয়। এই আবেগের জায়গা থেকেই অনেকেই সরকারের প্রতি দাবি তুলেছেন যে, এ মিলন মেলাকে যেন দুই বাংলার মানুষের মিলনমেলায় রূপান্তরিত করে স্থায়ী রূপ দেয়া হয়।