বাংলাদেশে স্মার্টফোন সংযোজন করতে যাচ্ছে নকিয়া ও শাওমি। এরই মধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে ফিনল্যান্ডভিত্তিক নকিয়া ফোনের নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান। লকডাউন দীর্ঘায়িত না হলে আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাবে বৈশ্বিক এই জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। অন্যদিকে চীনভিত্তিক বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান শাওমি বাংলাদেশে স্মার্টফোনের কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ তারা মোবাইল ফোন সংযোজন শুরু করবে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, শাওমি বাংলাদেশ কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নয়, সরাসরি কারখানা করতে যাচ্ছে। এ জন্য তারা বাংলাদেশে বড় ধরনের এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) নিয়ে আসছে। গাজীপুরে কারখানা স্থাপন করবে। এরই মধ্যে তারা প্রাথমিক অনুমতি পেয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত লাইসেন্স পাবে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সর্বশেষ নকিয়া বিটিআরসি থেকে লাইসেন্স পেয়েছে। তারা কারখানা করে উদ্বোধনের পর্যায়ে আছে। আমি যত দূর জানি শাওমিরও আসার কথা। লাইসেন্স খুব সহজেই পাওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক মানের তূলনায় যাতে একচুল পরিমাণ পার্থক্য না হয় সে বিষয় দেখা হয়। সে জন্য সবাইকে মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো নিশ্চিত করে কাজ করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘যেখানেই লাভের গুড় দেখে, সেখানেই পিঁপড়া আসে।
স্যামসাং, নকিয়া, শাওমি আসবে কেউ কল্পনাও করেনি। তারা দেখছে, বাংলাদেশে যে নানা রকম নীতি সহায়তা আছে, তাতে এখান থেকে ফোন প্রডাকশন করিয়ে নিয়ে বিদেশে বিক্রি করলেও লাভ হয়। আমরা এই জায়গাটি নিশ্চিত করেছি বলেই বর্তমানের প্রায় ৮০ শতাংশ স্মার্টফোনই দেশে তৈরি হচ্ছে। স্যামসাং-ওয়ালটনের মতো ব্র্যান্ডগুলো তাদের স্মার্টফোন রপ্তানিও করছে।’
মোস্তাফা জব্বার আরো বলেন, ‘২০১৮ সালে গ্রহণ করা উদ্যোগটি দেশের শিল্পায়ন বিকাশের ক্ষেত্রে, বিশেষত ডিজিটাল ডিভাইসের দেশীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে বিশেষভাবে আমার ব্যক্তিগত ও জাতিগতভাবে কৃতজ্ঞতা। অনেকেই এটি হতে পারে বলে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আমরা প্রমাণ করেছি যে বাঙালির মেধা, মনন ও আন্তরিকতা বিশ্বের সেরা।
আমরা এখন দেশে টুজি/থ্রিজি/ফোরজি, এমনকি ফাইভজি সেট বানাই। স্যামসাং নিজে আমাকে দেখিয়েছে যে তাদের সেরা ফোনসেটটি বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। আমি অনেক কারখানা ঘুরে আমাদের সন্তানদের দক্ষতা দেখে মুগ্ধ। বিটিআরসি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এর লাইসেন্সিং, গুণগত মান ও অন্যান্য বিষয় দেখাশোনা করে।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শাওমিকে এখনো চূড়ান্ত লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। তাদের একটি ডকুমেন্ট দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ শুরু করলে সব কিছু পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার এবং বাংলাদেশের ইউনিয়ন গ্রুপের জয়েন্ট ভেঞ্চার ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার (বিডি) লিমিটেড বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন থেকে এ বছরের মার্চে স্থানীয় পর্যায়ে নকিয়া ফোন উৎপাদনের অস্থায়ী লাইসেন্স পেয়েছে।
জানা গেছে, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজলার বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটির ৫ নম্বর ব্লকে পাঁচ একর জমি বরাদ্দ নিয়ে কারখানা স্থাপন করেছে নকিয়া মোবাইল। ২০১৭ সালের ২৪ মে জমি বরাদ্দ নিয়ে অবকাঠামো গড়ে তোলার কাজ শুরু করে কম্পানিটি। ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার (বিডি) লিমিটেড এই বরাদ্দ নেয়। গত ২৩ মার্চ বিটিআরসি ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যারকে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও বণ্টনের জন্য ভেন্ডর এনলিস্টমেন্টের তিন বছর মেয়াদি অস্থায়ী সনদ প্রদান করে। কারখানা নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য তারা চার কোটি ডলার পর্যায়ক্রমে বিনিয়োগ করবে। এই কারখানায় দুই শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
ভাইব্র্যান্ট সফটওয়্যার (বাংলাদেশ) লিমিটেডের চেয়ারম্যান রাকিবুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে নকিয়া স্মার্টফোন উৎপাদনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছি। বর্তমানে চারটি প্রডাকশন লাইনে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলছে। লকডাউন দীর্ঘায়িত না হলে আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারব বলে আশা করছি। প্রাথমিকভাবে আমরা নকিয়া ৩.৪ এবং জি-১০ সিরিজের স্মার্টফোন নিয়ে আসছি। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য স্মার্টফোনও সংযোজন করতে পারব বলে আশা করছি।’
নকিয়ার নির্মাতা এইচএমডি গ্লোবাল ওওয়াই বাংলাদেশের হেড অব বিজনেস ফারহান রশীদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নকিয়া তাদের ডিভাইসে কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করে। সেটা যেখানেই তৈরি হোক, মান একই। তাই দেশে সংযোজিত মোবাইল ফোনে মানের কোনো তারতম্য হবে না।’ তিনি বলেন, ‘দেশে সংযোজিত স্মার্টফোনের দাম বর্তমানের চেয়ে কম হবে বলে আশা করছি। উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিট প্রাইস কমে এর সুফল গ্রাহক পাবে।’
বৈশ্বিক বাজার গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ক্যানালিসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্মার্টফোন সরবরাহে অ্যাপলকে পেছনে ফেলে সম্প্রতি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন কম্পানির তালিকায় উঠে এসেছে শাওমি। ২০২১ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিশ্বে মোট স্মার্টফোনের সর্বোচ্চ ১৯ শতাংশ সরবরাহ করে প্রথম স্থানে রয়েছে স্যামসাং। ১৭ শতাংশ করেছে শাওমি এবং অ্যাপল করেছে ১৪ শতাংশ।
দেশে দেশীয় মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন শিল্প যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালে। সে সময় ওয়ালটন বাংলাদেশে তাদের ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন শুরু করে। এরপর বৈশ্বিক স্মার্টফোন সরবরাহকারী কম্পানি স্যামসাং, সিম্ফোনি, অপ্পো, রিয়েলমিসহ সর্বমোট ১০টি ব্র্যান্ড বাংলাদেশে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। দেশীয় বাজারের ৮৫ শতাংশ এসব ব্র্যান্ড উৎপাদন করে থাকে এবং স্মার্টফোন ও ফিচার ফোনের দেশীয় চাহিদার ৫৫ শতাংশ পূরণ করতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে অবস্থিত কারখানায় স্থানীয়ভাবে সম্পূর্ণ ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ স্মার্টফোন প্রস্তুত করছে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল স্মার্টফোন ব্র্যান্ড রিয়েলমি। বাংলাদেশে রিয়েলমির অফিশিয়াল কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তাদের পণ্যগুলো দেশে সেমি নকড-ডাউন (এসকেডি) পদ্ধতিতে অ্যাসেম্বল করা হয়; কিন্তু রিয়েলমি সি২১ তাদের প্রথম স্মার্টফোন, যেটি কমপ্লিটলি নকড-ডাউন (সিকেডি) প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশে তৈরি করা হয়েছে। দেশের বাজারে সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের কোয়ালিটি সনদপ্রাপ্ত রিয়েলমি সি২১-এর উৎপাদন একটি মাইলফলক।
স্থানীয়ভাবে স্মার্টফোন তৈরি ছাড়াও আগামী তিন বছরের মধ্যে তরুণ ব্যবহারকারীদের কাছে ১০ কোটি ফাইভজি স্মার্টফোন সরবরাহের লক্ষ্যে রিয়েলমি ফাইভজি পণ্যের এক বিস্তৃত পোর্টফোলিও তৈরির কাজ করছে।