শুক্রবার, সামান্য ইবাদতেই অফুরন্ত নিয়ামতে পূর্ণ যে দিনটি। মহান আল্লাহ তা‘আলার নিকট যে দিনটি অতি মর্যাদার। পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন থেকেও যে দিনটি শ্রেষ্ঠ (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং. : ৩/৪৩০, ইবনে মাজাহ, হাদীস নং. : ১০৮৪)। সে দিনটির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট জুমার সালাত। যার ফজিলত বর্ণনাতীত। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছা.) বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন ভালোভাবে গোসল করে।
অতঃপর সকাল সকাল পায়ে হেঁটে মসজিদে যায় এবং (আগে ভাগে নফল সালাত শেষে) ইমামের কাছাকাছি বসে ও মনোযোগ দিয়ে খুৎবার শুরু থেকে শুনে এবং অনর্থক কিছু না করে, তবে তার প্রতি পদক্ষেপে রয়েছে এক বছরের ছিয়াম ও ক্বিয়ামের অর্থাৎ দিনের ছিয়াম ও রাতের নফল ছালাতের সমান নেকী (আহমাদ, হাদিস নং. : ১৬২১৭, তিরমিযী, হাদিস নং. : ৪৯৬, মিশকাত, হাদিস নং. : ১৩৮৮)১। অথচ জুমার সালাত আদায় করতে গিয়ে আমরা এমন কিছু আমল বা কাজ করি যা পবিত্র কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীস সমর্থিত নয়। এমন কিছু বিষয় নিয়েই নিম্নে আলোচনা করা হলো।
মসজিদে এসেই বসে পড়া:
জুমার সালাতে এসে প্রায়শই আমরা যে কাজটি করে থাকি, তাহলো মসজিদে গিয়েই বসে পড়া। অথচ এটা রাসূল (ছা.) এর সুন্নাতের চূড়ান্ত খেলাফ এবং মসজিদের হক ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করা। কেননা রাসূল (ছা.) মসজিদে এসে প্রথমেই দুই রাক‘আত মসজিদের সালাত আদায় না করা পর্যন্ত কাউকে বসতে নিষেধ করেছেন। বর্ণিত হয়েছে, আবু কাতাদা (রা.) বলেন, নবী (ছা.) বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে তখন সে যেন না বসে, যতক্ষণ দুই রাক‘আত সালাত না পড়বে (ছহীহ বুখারী, হাদীস নং. : ১১৬৩, ১/১৫৬ পৃষ্ঠা)। এমনকি জুমার দিনে খুৎবা চলাকালীনও কেউ যদি মসজিদে প্রবেশ করে তবুও তাকে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করতে হবে। বর্ণিত হয়েছে, জাবের (রা.) বলেন, নবী করীম (ছা.) জুমার দিনে খুৎবা দিচ্ছিলেন এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে। তখন রাসূল (ছা.) তাকে বললেন, তুমি কি সালাত আদায় করেছ? সে বলল না। তখন তিনি বললেন, তুমি দাঁড়াও দুই রাক‘আত সালাত আদায় কর (ছহীহ বুখারী, ইফাবা. হাদীস নং. : ৮৮৩ ও ৮৮৪, ২/১৯০ ও ১৯১ পৃষ্ঠা, ছহীহ মুসলিম, হাদীস নং. : ২০৫৫ ও ২০৫৬, ১/২৮৭ পৃষ্ঠা)। সুতরাং মসজিদে প্রবেশ করেই আমাদের কমপক্ষে দুই রাক‘আত ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ সালাত আদায় করতেই হবে (প্রশ্নোত্তরে জুমা ও খুৎবা, অধ্যাপক মুহাম্মদ নূূরুল ইসলাম, পৃষ্ঠা নং. : ২৪)।
চার রাক‘আত কাবলাল জুমা :
জুমার সালাতে বাংলা বয়ানের পর ইমাম কতৃক চার রাক‘আত ‘কাবলাল জুমা’ সালাত আদায়ের সময় দেয়া হয়। অথচ জুমার পূর্বে কাবলাল জুমা নামে চার রাক‘আত বিশিষ্ট সালাত আছে কি? এ সম্পর্কে মুফতি কাজী ইব্রাহীম বলেন, জুমার পূর্বে চার রাক‘আত ‘কাবলাল জুমা’ সালাত ছহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত নয়। বরং মসজিদে প্রবেশ করেই প্রথমে দুই রাক‘আত ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ আদায় করবে এরপর দুই রাক‘আত করে নফল সালাত আদায় করবে খুৎবা শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ২। ড. মুযাফফর বিন মুহসিন রচিত ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছা.) এর সালাত’ গ্রন্থের ৩৫১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘জুমার পূর্বে কোন রাক‘আত নির্ধারিত নেই। যত ইচ্ছা তত পড়বে’।
উপরন্তুু অধ্যাপক মুহাম্মদ নূূরুল ইসলাম তার রচিত ‘প্রশ্নোত্তরে জুমা ও খুৎবা’র ২৪ পৃষ্ঠায় বলেন, ‘প্রচলিত কাবলাল জুমা শিরোনামে চার রাক‘আত বিশিষ্ট কোন সালাত সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না। খুৎবার পূর্বে এক সালামে চার রাক‘আত সালাত আদায়ের পক্ষে যে দলিল উপস্থাপন করা হয় তা খুবই দূর্বল যা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কমপক্ষে দুই রাক‘আত ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ সালাত পড়তেই হবে।’
খুৎবা চলাকালীন মসজিদে লাল বাতি জ্বালিয়ে দেয়া :
জুমার খুৎবা চলাকালীন সময়ে কেউ যাতে সালাতের নিয়ত না করেন সে জন্য মসজিদে লাল বাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। যা সুন্নাত পরিপন্থি। কেননা খুৎবার ভিতরেও দুই রাক‘আত ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ সালাত আদায় করতে হবে মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছা.) যে নির্দেশ দিয়েছেন তা ইতঃপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে খুৎবার সময় সালাত না আদায় করার পক্ষে যে দলিল পেশ করা হয় তা হলো (ক) আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছা.) বলেন, ইমাম খুৎবা দেওয়া অবস্থায় তোমরা সালাত আদায় কর না (আবু সাঈদ মালীনী, আল-ইহকামু উস্তা, ২/১১২ পৃষ্ঠা)। (খ) ইবনু ওমর (রা.) বলেন, রাসূল (ছা.)-কে আমি বলতে শুনেছি যে, ইমাম খুৎবা দেওয়া অবস্থায় তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন ইমাম খুৎবা শেষ করা পর্যন্ত কোন সালাত নেই ও কোন কথাও নেই (মাযমাউয যাওয়ায়েদ, ২/১৮৪ পৃষ্ঠা)।
বস্তুত উভয় বর্ণনাকেই জাল এবং বাতিল বলে উল্লেখ করেছেন ড. মুযাফফর বিন মুহসিন তার ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর সালাত’ গ্রন্থের ৩৫৮ পৃষ্ঠায়। এ সম্পর্কে শায়খ নাসির উদ্দিন আলবানী বলেন, ‘আমি এই হাদীছের উপর বাতিল হওয়ার হুকুম আরোপ করছি। কারণ এর সনদ যঈফ হওয়ার পাশাপাশি দুইটি ছহীহ হাদীছের বিরোধী’ (সিলসিলা যঈফাহ ১/১৯৯-২০১ পৃষ্ঠা, হাদীছ নং. ৮৭)। লাল বাতিকে মসজিদের নতুন একটি ফিতনা বলেও উল্লেখ করেছেন ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর।৩
সালাত শেষে সম্মিলিত দো‘আ ও কারো জন্য দো‘আ চাওয়া :
জুমা সালাত শেষে সম্মিলিত দো‘আ এবং উক্ত দো‘আর মধ্যে কোন ব্যক্তির নিজ বা তার পিতা, মাতার রোগ মুক্তি বা অন্য কোন কারণে ইমাম কর্তৃক সবার নিকট দো‘আ চাওয়া হয়। অথচ দো‘আ চাওয়ার এটি কোন সুন্নাত পন্থা নয়। রাসূল (ছা.) ও তার ছাহাবীগণ থেকে উক্ত পদ্ধতিতে দো‘আ চাওয়ার কোন প্রমান খুঁজে পাওয়া যায় না। দো‘আ চাওয়ার নিয়ম হল কেউ অসুস্থ্য হলে বা কোন সমস্যায় পড়লে এলাকার জীবিত দ্বীনদার, পরহেযগার, হক্বপন্থী আলেমের নিকট দো‘আর জন্য বলা। উক্ত আলেম প্রয়োজনে ওযু করে ক্বিবলামুখী হয়ে তার জন্য হাত তুলে আল্লাহর নিকট দো‘আ করবেন। যা ছাহাবারা করতেন।
অপর নিয়মটি হল বিপদগ্রন্থ ব্যক্তি সকলের নিকট দো‘আ চাইবেন। অথবা ইমাম কারো পক্ষ থেকে সকলের নিকট দো‘আ চাইতে পারেন। সকলে নিজ নিজ দো‘আয় উক্ত ব্যক্তির জন্য দো‘আ করবেন। যা ছালাতের মধ্যে অথবা ছালাতের বাইরে উভয়ই হতে পারে (জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছা.) এর সালাত, ড. মুযাফফর বিন মুহসিন, পৃষ্ঠা নং. : ৩৬৩-৩৬৪ )। ইমাম জুমার খুৎবায়ও তার জন্য দো‘আ করতে পারেন এবং মুসল্লীগণ আমীন আমীন বললে (ফাতাওয়া লাজনা ৮/২৩০-২৩১ ও ৩০২ পৃষ্ঠা, আল্লামা উছায়মীন, ফাতাওয়া আরকানিল ইসলাম, পৃষ্ঠা : ৩৯২)।
জুমার সালাতে পাগড়ী পরিধান :
রাসূল (ছা.) বিভিন্ন পেক্ষাপটে পাগড়ী পরিধান করেছেন যা নানা বর্ণনা থেকে প্রমানিত। কিন্ত পাগড়ী পরিধানরত সালাত পাগড়ীহীন সালাত অপেক্ষা ফজিলতপূর্ণ মর্মে কোন বর্ণনা প্রমানিত নয়। অনেকেই অধিক ফজিলত মনে করে শুক্রবার জুমার ছালাতে পাগড়ী পরে আসেন। এবং তারা মনে করেন যে, পাগড়ীসমেত সালাত পাগড়ীহীন সালাত অপেক্ষা সত্তর গুন ছোয়াব। অথচ পাগড়ী পরিধানের ফজিলত সম্পর্কিত যত হাদীস রয়েছে তা সবই জাল বলে উল্লেখ করেছেন ড. মুযাফফর বিন মুহসিন তার ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছা.)-এর সালাত’ গ্রন্থের ৩৬২ নং পৃষ্ঠায়। বিংশ শতাব্দীর শেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসির উদ্দিন আলবানী (র.) তার রচিত ফাতাওয়া গ্রন্থ ‘আল-আজউয়ীবা নাফেয়া আল আস্ইলাতি লাজ্নাতি মাসজিদিল জামেআ’ গ্রন্থের ৬৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে, শুধুমাত্র খুৎবা দেওয়া বা জুমার সালাত পড়ার সময় পাগড়ি ব্যবহার করা কোনো সাওয়াবের কাজ নয়; বরং এটা বিদ‘আত।৪ এতৎসংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হাদীস হলো :
(ক) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা.) বলেন, আমি রাসূল (ছা.)-কে বলতে শুনেছি যে, পাগড়ী মাথায় দিয়ে এক ওয়াক্ত সালাত আদায় করলে পাগড়ী বিহীন ২৫ ওয়াক্ত ছালাতের সমান নেকী হয় এবং পাগড়ী পরে এক জুমা পড়লে পাগড়ীবিহীন ৭০ জুমার সমপরিমাণ নেকী হয়। নিশ্চয় ফেরেশতারা পাগড়ী পরে জুমার ছালাতে শরীক হন। তারা পাগড়ী পরিহিত ব্যক্তিদের জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত দো‘আ করতে থাকেন (ইবনু নাজ্জার, সিলসিলা যঈফাহ, হাদীস নং. : ১২৭, পৃষ্ঠা নং. : ১/২৪৯)। বস্তুুত বর্ণনাটি জাল। এর সনদে আব্বাস ইবনু কাছীর নামে মিথ্যুক রাবী আছে (সিলসিলা যঈফাহ, হাদীস নং. : ১২৭ এর আলোচনার দ্র. পৃষ্ঠা ১/২৪৯)৫।
(খ) আবু দারদা (রা.) বলেন, রাসূল (ছা.) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ও ফেরেশতামন্ডলী জুমার দিনে পাগড়ী পরিহিত ব্যক্তিদের উপর রহমত বর্ষণ করেন (আবু নু‘আইম, আল-হিলইয়া, ৫/১৮৯-১৯০ পৃষ্ঠা। ত্বাবারানী, আল-কাবীর, সিলসিলা যঈফাহ, হাদীস নং. : ১৫৯)। উল্লেখ্য যে, হাদীসটি জাল বা মিথ্যা কেননা উক্ত বর্ণনার সনদে আইয়ুব ইবনু মুদরাক নামে মিথ্যুক রাবী রয়েছে (ইবনু জাওযী, কিতাবুল মাওযূ‘আত ২/১০৫ পৃষ্ঠা, সিলসিলা যঈফাহ হাদীস নং. : ১৫৯)। তবে ফযীলতের আশা না করে কেউ মাথায় পাগড়ী বা রুমাল ব্যবহার করতে পারেন (ছহীহ মুসলিম, হাদীস নং. : ৩৩৭৫-৩৩৭৮, মিশকাত, হাদীস নং. : ১৪১০)৬।
যা কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীস সমর্থিত নয় এমন আমল থেকে বিরত থেকে মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সঠিক ও সত্যটি জানা ও মানা এবং তা অন্যের নিকট পৌছে দেয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।