কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কুনকুনিয়ার হাওর থেকে ধান কেটে ফিরেছেন করিমগঞ্জ উপজেলার গুজাদিয়া টামনি গ্রামের কৃষক মর্তুজ আলী। বিশাল নৌকায় ধানের সাথেই আছে মাড়াইকল, গরু ও আসবাবপত্র।হাওরে দীর্ঘ ৬ মাস ফসলের মাঠে দিন কাটানোর পর ভাটির প্রবেশদ্বার হিসেবে
পরিচিত করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়া নৌ-বন্দরে তাদের বহনকারী নৌকাটি ভিড়তেই তীরে নামেন মর্তুজ আলী। প্রখর রোদে বিবর্ণ দেহ। তবে মুখে চওড়া হাসি। যেন রাজ্য জয় করে ফিরেছেন তিনি!জানালেন, নানা ঝক্কি-ঝামেলার পরও এবার বোরো ধানের ফলন হয়েছে বাম্পার।
গেল সপ্তাহে আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস ছিল উজানে অতিবৃষ্টি হতে পারে। তাই ধান কাটা নিয়ে অন্য সবার মতো সংশয় ছিল কৃষক মর্তুজ আলীর। তবে শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় সময়মতো ধান কেটে নিরাপদে নিয়ে আসতে পারায় তার চোখে-মুখে তৃপ্তির ঝিলিক।
দুর্যোগ-দুর্বিপাক ছাড়াই সময়মতো কষ্টে বুনা ফসল ঘরে তুলতে পেরে তার মতো খুশি হাওরের হাজার হাজার কৃষক। সেই সাথে বাজারে ধানের ভালো দাম থাকায় লাভবান হচ্ছেন তারা।
হাওর থেকে নৌকায় করে চামড়া নৌ-বন্দরে আসছে হাজার হাজার মেট্রিক টন ধান। নদীর পাড় থেকে ট্রাকে করে পরিবহন করা হচ্ছে সড়ক পথে। এমন দৃশ্য চোখে পড়বে হাওরের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়া নৌ-বন্দরে। আবহাওয়া বিভাগের অতিবৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও শেষ পর্যন্ত কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষের পথে হাওরের ধান কাটা। মাড়াই-ঝাড়াই শেষে এখন চলছে পরিবহন।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কিশোরগঞ্জের হাওরে শেষের পথে বোরো মওসুমের ধান কাটা। এরইমধ্যে শেষ হয়েছে ৯১ ভাগ জমির ধান কাটা। করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়া নৌবন্দর দিয়ে প্রতিদিন আসছে হাজার হাজার মেট্রিক টন ধান।
এদিকে ধানের দাম ভালো থাকায় খুশি কৃষক। ঘাটেই ধান বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৭শ থেকে সাড়ে ৯শ টাকায়। বাজারে দাম বেশি থাকায় সরকারি গুদামে ধান দিতে খুব বেশি আগ্রহ নেই কৃষকের।
নরসুন্দা নদীর তীরে চামড়া নৌ-বন্দরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আসছে একের পর এক ধানবোঝাই নৌকা। নৌকা থেকেই ট্রাকে তুলে পরিবহন করা হচ্ছে নতুন ধান। বাম্পার ফলন আর বাজারে দাম বেশ পাওয়ায় খুশি কৃষক। অনেকেই বন্দরের আড়ৎগুলোতে বিক্রি করে দিচ্ছেন আধা-শুকানো ধান। বন্দরের ঘাটে প্রায় ৫০টি আড়তে চলছে নতুন ধান কেনা-বেচা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় আরও বেশি দাম পাওয়ার আশায় কৃষকরা ধান বিক্রি করছেন কম।সূতারপাড়া গ্রামের কৃষক আ. মন্নাছ জানান, এবার তিনি দেড় হাজার মণ ধান পেয়েছেন। গরম আবহাওয়ায় কিছুটা চিটা হলেও ধানের ফলন ভালো হয়েছে।
তিনি জানান, এক হাজার টাকা মণ দরে সাড়ে ৯শ মণ ধান বিক্রি করেছেন। বাকি ধান বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন।আড়ৎ মালিক মো. নজরুল ইসলাম জানান, এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় সহজেই কৃষক মাঠের ধান কেটে মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর কাজ শেষে নিয়ে ফিরতে পেরেছেন। ধানের দাম আরও বাড়তে পারে। তাই কৃষকরা এবার ধান বিক্রি করছেন কম। মজুদের জন্য বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।
আড়ৎ মালিকরা জানান, বর্তমানে বাজারে বিআর-২৮ জাতের শুকনো ধান ৯শ থেকে সাড়ে ৯শ, বিআর-২৯ ৮শ থেকে সাড়ে ৮শ এবং হিরা জাতের ধান ৭৫০ থেকে ৮শ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
অপরদিকে সরকারি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষকদের আগ্রহ কম থাকায় এবার ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে কিনা-এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে নির্ধারিত সময়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে মনে করেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম।
তিনি জানান, অ্যাপস এবং লটারির মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা শুরু হয়েছে। এবার জেলায় ২৩ হাজার ৩৪৬ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম জানান, এবার জেলায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ লাখ ১১ হাজার ৫৮০ মেট্রিক টন। তবে ফলন ভালো হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।
সোমবার পর্যন্ত জেলার হাওর উপজেলাগুলোতে ৯১ ভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। আর পুরো জেলায় ধান কাটা শেষ হয়েছে ৭৮ ভাগ জমির। কাস্তের পাশাপাশি কৃষি বিভাগের উদ্যোগে শতাধিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটায় দ্রুত শেষ হয়েছে হাওরের ধান কাটা।