শ্রীলঙ্কার প্রধান বিরোধীদলের তরুণ রাজনীতিবিদ রেহান জয়াবিক্রমে। গত ১৩ তারিখ ছোট্ট এক ঘোষণা দিয়ে তিনি বিস্ময় সৃষ্টি করেন। টুইটারে রেহান লেখেন, আমি বৌদ্ধ এবং জীবনে বৌদ্ধদর্শন মেনে চলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। এরপরেও জানাতে চাই, আমি আমার মুসলিম ভাই-বোনদের সঙ্গে পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য অপেক্ষা করছি। এটি হবে আমার জীবনে প্রথম রোজা রাখা, সুতরাং আপনারা আমার জন্য প্রার্থনা করবেন।
ঘোষণা অনুসারে পরের দিন থেকেই রোজা রাখছেন শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলীয় ওয়েলিগামা শহরের আরবান কাউন্সিলের এ চেয়ারম্যান। বৌদ্ধপ্রধান দেশ শ্রীলঙ্কায় এবার রমজান যেদিন থেকে শুরু হয়েছে, সেদিনই দেশটির সিনহালা ও তামিল জনগোষ্ঠী তাদের নববর্ষ পালন করছে। কিন্তু সেখানকার এমন সমাজ ব্যবস্থায় বড় আঘাত করে দু’বছর আগে ইস্টার সানডেতে একাধিক গির্জায় জ’ঙ্গি হা”মলার ঘটনা। এতে প্রায় ২৭০ জন নিহ’ত হন।
রেহান জয়াবিক্রমে জানান, তিনি যে রমজান মাসজুড়ে রোজা রাখতে চান, এর লক্ষ্য হলো- সেই হা’ম’লা’র পর শ্রীলঙ্কায় যে মুসলিমবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে, তা দূর করা। রোজা রাখার ঘোষণার পর টুইটারে তার প্রতি সমর্থন ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অনেকে।
তবে অমুসলিম হিসেবে রমজান পালন যে রেহানই প্রথম করছেন, তা কিন্তু নয়। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে থাকেন ম্যারিয়ান ডেভিড। পেশায় সাংবাদিক এ নারী জানান, তিনিও কয়েক বছর ধরে এটি করে আসছেন।
ম্যারিয়ান বলেন, ক্যাথলিক খ্রিস্টান হলেও আমিও রমজানের সময় রোজা রাখি। এর ফলে আমার মনে দারুণ স্পষ্টতা, সচেতনতা, সহমর্মিতা এবং শৃঙ্খলাবোধ আসে। আশা করি জয়াবিক্রমে যেন ভালোভাবেই এটি করতে পারেন।
একই কাজ করেছেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আন্তর্জাতিক বিষয়ক মহাপরিচালক অনুরাধা কে হেরাথও। তিনি টুইটারে বলেন, অনেক দিন আগে যখন মোরাতুয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, তখন আমিও রোজা রেখেছিলাম। বন্ধু সিফান আমাকে অনেক ভোরে খাওয়ার জন্য জাগিয়ে দিত। বিকাল বেলা লেকচারের ফাঁকে রোজা ভাঙার সময় সে আমার সঙ্গে তার খাবার ভাগ করে নিত। আশা করি, আপনার (জয়াবিক্রমে) এ অভিজ্ঞতা চমৎকার লাগবে।
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরেহান জয়াবিক্রমে বলেন, আমাদের দেশে কিছু নেতা বর্ণবাদ উসকে দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে আমি রোজা রাখার চিন্তা করি। এর অর্থ এই নয় যে আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমি বর্ণবাদের প্রতিবাদ করছি।
অবশ্য কিছু সমালোচক অভিযোগ করেছেন, এর উদ্দেশ্য মুসলিমদের ভোট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। জবাবে রেহান জয়াবিক্রমে বলেছেন, ধর্মীয় সম্প্রীতি উৎসাহিত করে ভোট পাওয়া ঘৃণা সৃষ্টির চেয়ে অনেক ভালো।
মনঃসংযোগ বৃদ্ধিসাংবাদিক ম্যারিয়ান ডেভিড একজন ক্যাথলিক। কিন্তু গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রমজানে রোজা রাখেন তিনি।ম্যারিয়ান বলছেন, এ সময়টিকে তিনি মনসংযোগ বৃদ্ধি এবং সত্যিকারের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার জন্য ব্যবহার করেন।
তিনি বলেন, কী খাবো তা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা, খাদ্যের জন্য মনোযোগ অন্যদিকে চলে যাওয়া এবং অকারণে একটু পর পর খাওয়া- রোজার ফলে এগুলো থেকে অনেকটা রেহাই পাওয়া যায়। এটি পুরো দিনকে শৃঙ্খলার ভেতর নিয়ে আসে।
ম্যারিয়ান মনে করেন, রোজা পালন তার মনঃসংযোগকে শাণিত করে এবং নিজেকে অনেক স্বাস্থ্যবান মনে হয়। এছাড়া, রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যাদের একবেলা খাবার জোটাতে কষ্ট করতে হয় তাদের চিন্তা করা।
তিনি বলেন, আমার মনে হয় নিজে রোজা পালনের পাশাপাশি যতটা পারা যায় দান করা, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের খাওয়ানো এবং তাদের রোজা রাখতে সহায়তা করাও সমানভাবে প্রয়োজনীয়।
সংহতি
শ্রীলঙ্কা থেকে বহুদূর যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন নাদিন পার। তিনিও আরেকজন অমুসলিম যিনি রমজানে রোজা রাখেন। খ্রিস্টান ধর্মানুসারী নাদিনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীও মুসলিম।
রোজা পালন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি আমার মুসলিম বন্ধুদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের একটি উপায়। তা ছাড়া যীশুর অনুসারী হিসেবে আমার নিজের ধর্মবিশ্বাসেরও একটি বহিঃপ্রকাশ।
স্কুলশিক্ষক নাদিন থাকেন মিশিগান অঙ্গরাজ্যের গ্র্যান্ড র্যাপিডসে। তিনি বলেন, গত সাত বছর ধরে আমি রমজানে রোজা রাখার নিয়ম মেনে চলছি। তখন আমি সকালের খাবার খাই সূর্যোদয়ের আগে আর সূর্যাস্তের আগপর্যন্ত সবরকম খাওয়া থেকে বিরত থাকি।
তার মতে, এটি বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির বন্ধুদের সঙ্গে সেতুবন্ধনের চমৎকার মাধ্যম।
সূত্র: বিবিসি বাংলা