বিরল অলওয়েদার সড়কে পর্যটনের তীর্থক্ষেত্র এখন হাওর

হাওর বৈচিত্রময় ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য এক স্বতন্ত্র সত্তা। এমন বিচিত্র প্রকৃতি ও জীবনধারা বাংলাদেশের আর

কোথাও দেখা যায় না। শুকনো মৌসুমে দিগন্তবিস্তৃত মাঠের পর মাঠ জুড়ে সবুজের সমারোহ আর অতিথি পাখির মেলা।

বর্ষায় চারদিক থৈ থৈ করা পানি। যেন সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে আছে কিশোরগঞ্জের হাওরের প্রকৃতি।

হাওরের এই সৌন্দর্যে এখন এক ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে নান্দনিক এক সড়ক। হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে বাস্তবায়িত হয়েছে ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি।

সড়কের দু’পাশে থৈ থৈ পানি, আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। মেঘ আর জলের এই মনোরম মিতালির সামনে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকা। সড়কের পাশে বসে বুকভরে নির্মল বাতাস উপভোগ আর হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না।

বর্ষাকালে হাওর এলাকায় অবস্থিত গ্রামগুলোকে দূর থেকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। মনে হয় যেন হাওরের পানিতে ভাসছে সেই সব গ্রাম। এ সময় হাওরে চলাচল করে শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা।

এগুলোই বর্ষাকালে হাওর এলাকার বাসিন্দাদের এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা কিংবা জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র বাহন।

শত শত রঙ্গিন পাল তোলা নৌকাও বর্ষায় চোখে পড়ে। জাহাজ আকৃতির মালামাল পরিবহনকারী বড় বড় কার্গো, দাঁড় বেয়ে চলা নৌকা ও মাঝিদের কন্ঠের সুরেলা গান এসবই হাওরের অনুসঙ্গ। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে জেলেদের জাল দিয়ে মাছ ধরা তো নিত্যদিনকার চিত্র।

রাতে নৌকায় কুপি বাতি জ্বালিয়ে জেলেদের মাছ ধরা দেখে দূর থেকে মনে হবে যেন গ্রাম্য কুলবধূরা শত শত প্রদীপ জ্বালিয়ে হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। হাওরের পানিতে হাঁসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিশুরা সারাদিন সাঁতার কাটায় মেতে থাকে।

চাঁদনী রাতে জ্যোৎস্নার আলোর সঙ্গে ঢেউয়ের মাতামাতি দেখলে নয়ন জুড়িয়ে যায়। বর্ষাকালে হাওরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য সত্যিই মনোরম!

গভীর হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য তৈরি করা নান্দনিক এই সড়কটি এখন সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে হয়ে ওঠেছে এক দুর্নিবার আকর্ষণের নাম। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এরই মাঝে আগামীর পর্যটন ঠিকানা হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে সড়কটি।

এর মাধ্যমে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় পর্যটন সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। একটি মাত্র সড়ক বদলে দিয়েছে হাওরের সামগ্রিক দৃশ্যপট। সড়কটি নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘ভাটির শার্দুল’ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

হাওরবাসীর কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এঁর অভিপ্রায় অনুযায়ী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সারা বছর চলাচলের লক্ষ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গৃহীত হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা কিশোরগঞ্জের পূর্ব প্রান্তে বিস্তীর্ণ হাওর

এলাকা নিয়ে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার অবস্থান। হাওর অধ্যুষিত এই তিনটি উপজেলা বছরে অর্ধেকের বেশি সময় জলমগ্ন থাকায় এলাকাটি অনগ্রসর ও দুর্গম হিসেবে পরিচিত।

হাওর এলাকায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বর্ষাকাল ও শুষ্ক মৌসুমে তিনটি উপজেলার জনগণকে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হতে হত।

হাওরবাসীর এই কষ্ট লাঘবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ হাওরের বুক চিরে অলওয়েদার সড়ক নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। তাঁর অভিপ্রায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সায় দিয়ে উদ্যোগ নেন বিশাল এই কর্মযজ্ঞের।

সড়কটি ইটনা উপজেলা সদর হতে শুরু হয়ে ধনু ও বাউলাই নদীর সমান্তরালে সম্পূর্ণভাবে বিস্তীর্ণ হাওরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে মিঠাইন উপজেলা সদর হয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা সদরে সমাপ্ত হয়েছে।

বর্ষাকালে হাওরের পানির প্রচণ্ড স্রোতে যেন নির্মিত সড়ক বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সড়কের সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যে সড়ক বাঁধের উভয় পাশের স্লোপে সিসি ব্লক দিয়ে প্রতিরক্ষা কাজ ও সড়ক বাঁধের স্থায়িত্বের জন্য টো-ওয়াল বরাবর সিসি ব্লক দ্বারা ফলিং এপ্রোনের কাজ করা হয়েছে।

বর্ষায় সড়কের দু’পাশের গ্রামসমূহে নৌপথে যাতায়াতের লক্ষ্যে সড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেতু নির্মাণ করা

হয়েছে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে কৃষি জমিতে যেন সেচ কাজ বাধাগ্রস্ত না হয় এবং হাওরের উৎপাদিত ফসলবাহী যানবাহন যেন সড়কের নীচ দিয়ে অনায়াসে যাতয়াত করতে পারে, সেজন্য সড়কের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।

হাওরবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন সদ্য নির্মিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়েছে হাওরের বিস্ময় হিসেবে। সড়কটি নির্মিত হওয়ায় অনুন্নত হাওর এলাকায় আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। সড়কটিতে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটকের আগমনে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ায় ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম তিন উপজেলার মধ্যে সারা বছর চলাচলের উপযোগী সড়ক নেটওর্য়াক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অদূর ভবিষ্যতে মিঠামইন উপজেলার সাথে একটি ফ্লাইওভারের মাধ্যমে করিমগঞ্জ

উপজেলার সাথে এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার সাথে তথা ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য জেলার সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।

হাওরের বিস্ময়খ্যাত এই সড়কটি এখন পরিণত হয়েছে পর্যটনের তীর্থক্ষেত্রে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই সড়কটি দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন সৌন্দর্য্য আর ভ্রমণপিপাসুরা। হাজারো পর্যটকের পদচারণায় এখন মুখরিত হাওরের একসময়ের অবহেলিত আর প্রত্যন্ত এই জনপদ।