বাড়িভাড়া ওঠে না খালিও থাকে, রাজধানীর আড়াই লাখ বাড়িওয়ালা সংকটে

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য রসুলপুরের দুই স্বামীহারা বাড়িওয়ালা খাদিজা বেগম ও হাসিনা বেগম করোনাকালে মহাসংকটে পড়েছেন। ৮৬৬ নম্বর বাড়ির মালিক খাদিজা বেগম। তিনটি টিনশেড ঘরের একটিতে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন, ভাড়া দেওয়া অন্য দুটি ঘরের আয় দিয়ে সংসার চালাতেন। দুই মাস হলো ভাড়াটিয়ারা বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন ভাড়াটিয়া পাননি। একমাত্র আয়ের পথ বাড়িভাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিশাহারা তিনি। একই এলাকার ৮৬৫ নম্বর বাড়ির মালিক হাসিনা বেগম। দোতলা বাড়ির নিচতলায় দুই মেয়ে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। দোতলার ভাড়া দিয়ে সংসার ও দুই মেয়ের পড়াশোনা চালাতেন। গত মাসে ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। এখন কিভাবে সংসার চলবে, কী দিয়ে মেয়েদের পড়াশোনা চালাবেন—সেই দুশ্চিন্তায় দিন যাচ্ছে হাসিনা বেগমের। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ভাড়াটিয়া নেই, আয় বন্ধ; কিন্তু সিটি করপোরেশনের ট্যাক্সসহ সব পাওনা তো দিতে হচ্ছে।’

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুসারে ঢাকায় বাড়ির সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৪০ হাজার। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা জানান, ঢাকা উত্তরে বাড়ির সংখ্যা দুই লাখ ২০ হাজার। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ থেকে জানা যায়, দক্ষিণে বাড়ির সংখ্যা এক লাখ ৫০ হাজার, তবে ঢাকা দক্ষিণের সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হওয়া পাঁচটি ইউনিয়নে আরো প্রায় ৭০ হাজার বাড়ি রয়েছে, যা এখনো সিটি করপোরেশনের আয়করের মধ্যে আসেনি। আসার কাজ চলছে।

ঢাকায় ভাড়াটিয়াদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রায় এক কোটি ৩৬ লাখ লোক ভাড়া থাকে। এদের বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত এবং প্রায় চার লাখের অধিক বাড়িওয়ালার মধ্যে প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার বাড়ির মালিকও মধ্যবিত্ত।’ করোনাকালে অনেক বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ যেমন করছেন, আবার ভাড়াটিয়াদের প্রতি মানবিক আচরণের কিছু উদাহরণও তৈরি হয়েছে। ঢাকা উত্তরের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের সেনপাড়া পর্বতা এলাকার সোলায়মান হক প্রায় দুই একর জায়গায় নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাসের জন্য তৈরি করা ঘরগুলোর ভাড়া তিনি অর্ধেক করে দিয়েছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ভাড়াটিয়াদের বেশির ভাগ রিকশাচালক, হকার, বাসাবাড়িতে ঝির কাজ করা লোক। ওদের এখন দুর্দিন বলে ভাড়া কমিয়ে দিয়েছি।’

ঢাকা শহরে চার ধরনের বাড়ির মালিক রয়েছেন। অধিক ধনী ও ধনী লোকেরা অভিজাত এলাকায় জমি ক্রয় করে এক বা একাধিক বাড়ির মালিক হয়েছেন। মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা তাঁদের সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থে অল্প পরিমাণ জায়গা কিনে বাড়ি নির্মাণ করেছেন, কারো কারো ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে কিছু লোক সরকারের কাছ থেকে জায়গা বরাদ্দ পেয়ে বাড়ি করেছেন। আরেকটি শ্রেণি পারিবারিক সূত্রে জায়গার মালিক হয়ে বাড়িওয়ালা হয়েছেন। এ ছাড়া এমন কিছু বাড়ি তথা ফ্ল্যাটের মালিক আছেন যাঁরা বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে জায়গা দিয়ে নিজেরা কিছু ফ্ল্যাট পেয়ে তা ভাই-বোনের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা শহর ছেড়ে অনেক ভাড়াটিয়া গ্রামসহ অন্যত্র চলে যাওয়ায় সংকটে আছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির দুই লাখ ৪০ হাজার বাড়িওয়ালা। তাঁদের বাড়ির ভাড়াটিয়ারা ছিলেন মধ্যবিত্ত। বেশির ভাগই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা লোক। চাকরি হারিয়ে তাঁরা বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন বা রাজধানীর আশপাশে কম ভাড়ায় বাসা নিয়েছেন।

মিরপুর ১২ নম্বরে কালশী সড়কে বাড়ির মালিক ইউসুফ আহমেদ তুহিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত হলেও বাড়িভাড়া কিছু কমানো যায় যদি সরকার আমাদের বাড়ি করার ব্যাংকঋণ, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল, সিটি করপোরশেনের হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেয়। সরকার সে বিষয়ে কিছু বলছে না, দিনে দিনে বাড়ি খালি হচ্ছে, আমরা বিপদে পড়ছি। বাড়িভাড়ার ওপর নির্ভরশীল আমাদের মতো লোকগুলো দুই দিকেই বিপদে— ভাড়াটিয়া নেই, আবার সরকারি সব পাওনা দিতে হচ্ছে।’

ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম মনে করেন, বাড়িভাড়ার বিষয়টির সংকট অনেক গভীরে, সহজ সমাধান নেই। ভাড়াটিয়ারা যেমন সমস্যায় তেমনি বহু বাড়িওয়ালা রয়েছেন যাঁদের ভাড়ার আয়ের ওপর সংসার চলে।’ কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বাড়িভাড়ার বিষয়টি সিটি করপোরেশনের অধীনে নয়। তবে আমি মনে করি, এটা সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত।’

ঢাকা উত্তরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ডি ব্লকের ১১/৩৩ নম্বর বাসার মালিক মো. রাসেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের ছয়তলা বাড়ির ছয়টি ইউনিট। একটাতে আমি থাকি, দুটিতে বোনেরা থাকে। বাকি তিনটি ইউনিট ভাড়া দিয়ে আমরা সংসারের খরচসহ প্রতি মাসে ব্যাংকঋণের ৫৬ হাজার টাকা পরিশোধ করতাম। এখন কোনো ভাড়াটিয়া নেই। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছি না। সংসারেও অভাব। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম, চাকরিটা চলে গেছে।’

ঢাকা দক্ষিণের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মকবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনার এ সময়ে প্রতিদিনই সালিস করতে হয় বাড়িভাড়া নিয়ে; সমস্যা ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালা দুজনেরই। অনেক বাড়িওয়ালা রয়েছেন যাঁদের সংসার চলে ভাড়ার টাকায়, তাঁদের অনেকের বাড়ি থেকে ভাড়াটিয়া চলে গেছেন। আবার অনেকের বাড়িতে ভাড়াটিয়া থাকলেও ভাড়া দিতে পারছেন না। আগামী মঙ্গলবার সিটি করপোরেশনের সভায় আমি বিষয়টি উত্থাপন করব। মেয়রকে বলব, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে একটি পদক্ষেপ নিতে।’ উত্তর সিটির ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাড়িভাড়ার বিষয়টি দেখেন ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। হাল সময়ের এ বড় সমস্যাটির আমরা শুধু সালিস করি। সমস্যা ভাড়াটিয়া বাড়িওয়ালা দুজনেরই। ঢাকায় বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত বাড়িওয়ালা। এদের সংসার চলে ভাড়ার টাকায়। আবার কাজ না থাকায় তাঁদের বাড়িতে থাকা মধ্যবিত্তরা ভাড়া দিতে পারছে না। এর পরিপূর্ণ সমাধান করতে হলে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে অনেক পক্ষ রয়েছে, ব্যাংকঋণের বিষয় আছে; গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি বিলের বিষয় ছাড়াও রয়েছে সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স। এসব পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগে হয় তো বাড়িভাড়া কমানো সম্ভব, যাতে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া দুই পক্ষ লাভবান হতে পারে।’