প্রচারণায় নজির গড়ছে ধানমন্ডির উপনির্বাচন

দেশে স্থানীয় কিংবা জাতীয় পর্যায়ের যেকোনো নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা পেয়ে বসে প্রার্থী, কর্মী, সমর্থক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে। প্রার্থী ও কর্মীদের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ চিরাচরিত ঘটনা। এই প্রবণতার বিপরীতে গিয়ে অনেকটা সম্প্রীতির নজির তৈরি হয়েছে ঢাকা-১০ (ধানমন্ডি) আসনের উপনির্বাচনে।

ব্যতিক্রমীভাবে অনেকটা নিরুত্তাপ চলছে এই আসনের প্রচার-প্রচারণা। এর কারণ এমন নয় যে, এই আসনের মেয়াদ মাত্র অল্প কদিন বাকি বলে গুরুত্বহীন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের মাত্র এক বছরের মাথায় শেখ ফজলে নূর তাপস পদত্যাগ করায় এই আসনের মেয়াদ রয়েছে আরও চার বছর। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর তিনি সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করেপারেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। গত ১ ফেব্রুয়ারির ভোটে তিনি মেয়র নির্বাচিত হন।

সংসদের এই শূন্য আসনে উপনির্বাচনে প্রচারণার শুরু থেকে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত ১০ দিন ধরে চলছে এই ভিন্ন ধাঁচের প্রচার। এখন পর্যন্ত বড় দলের প্রার্থীদের নেই একে-অপরের প্রতি কোনো পাল্টাপাল্টি অভিযোগ।

বাংলাদেশের নির্বাচনের সেই চিরপরিচিত দৃশ্য- যখন তখন বিকট আওয়াজে মাইকিং, রাস্তাঘাট বন্ধ করে শোডাউন, ফুটপাত দখল করে নির্বাচনী ক্যাম্প- এসবের কোনোটিরই দেখা নেই ঢাকা-১০ উপনির্বাচনে। এমনকি যতযত্র পোস্টারও নেই নির্বাচনী এলাকায়। প্রার্থীদের সঙ্গে দলের শীর্ষ নেতাদেরও দেখা যায় না তেমন। তাই বলে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই। তারা প্রার্থীদের ঘিরে প্রচারণায় যাচ্ছেন ভোটারদের দ্বারে।

এমন সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে খোদ নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনী প্রচারণার ধরন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ছয় প্রার্থীর সঙ্গে আগেই সমঝোতা করে নিয়েছে তারা। আর এতেই এমন স্বস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে নির্বাচনী এলাকায়। ভোটাররা আশা করেন, এই পরিবেশ যেন শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে।

তবে সমঝোতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত প্রচারণার কারণে নির্বাচনী উত্তাপ কিংবা মুখর পরিবেশ তৈরি হয়নি। তাই অনেকে উপনির্বাচনের ভোট নিয়ে বিভ্রান্ত বলে জানান হাতিরপুলের বাসিন্দা জহির শিকদার। তিনি বলেন, ‘এতদিন নির্বাচনে হইহুল্লুড় আর জমজমাট প্রচারণা দেখে অভ্যস্থ মানুষ হঠাৎ ব্যতিক্রমী পরিবেশ দেখে মেলাতে পারছে না। নীরবে ভোট চেয়ে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। তাই তাদের দেখা পান না অনেকে।’

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ছয় প্রার্থীর সঙ্গে ছয়টি বিষয়ে সমঝোতা হয় ইসির। এর মধ্যে পোস্টারিংয়ের জন্য সংসদীয় এলাকায় ২১টি স্থান নির্ধারণ করা হয়। সেই শর্ত মেনে গত ১ মার্চ পোস্টারিং ও প্রচারণা শুরু করেন প্রার্থীরা।

একই সঙ্গে গণসংযোগ করছেন প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শেখ রবিউল আলম রবি ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। নিয়মিত দিনভর প্রচারণা চালিয়ে অনেকটা এগিয়ে আছেন ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী রবিউল। আর দিনে এক বেলা করে প্রচারণা চালাচ্ছেন নৌকার প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির মো. শাহজাহানও মাঝে মধ্যে প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্য চার প্রার্থীর কারও কারও পোস্টার দেখা গেলেও প্রচারণা দেখা যায়নি।

অন্য প্রার্থীরা হলেন বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) আব্দুর রহীম।

প্রার্থীরা বলছেন, নির্বাচনী প্রচারণার এমন সম্প্রীতির উদ্যোগকে এলাকার মানুষ ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। তারাও প্রচারণায় বেশ সাড়া পাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘জনগণের সেবা করার জন্য প্রার্থী হয়েছি। সেখানে জনদুর্ভোগ হোক এটা কেউ ভালোভাবে নেয় না। তাই নতুন যে নিয়ম করে দেয়া হয়েছে এটা সবাই ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। সবাই এই উদ্যোগে একমত হতে পেরেছি এটাও ভালো দিক।’

বিএনপিও এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন। দলের মনোনীত প্রার্থী রবিউল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘একটা বাসযোগ্য শহরের জন্য এটা প্রয়োজন রয়েছে। এটাকে স্বাগত জানিয়েছি। যে বিধিবিধান দিয়েছে তা আমি মেনে চলছি। প্রচারের নামে ঢাকা শহরকে যেভাবে জঞ্জাল তৈরি করা হয় তা কোনোভাবে কাম্য নয়।’

প্রার্থীদের সঙ্গে যেসব সমঝোতা

প্রত্যেক প্রার্থী প্রতি ওয়ার্ডে ১টি করে নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করতে পারবেন এবং ১টি মাইক ব্যবহার করতে পারবেন। প্রার্থী বা তার পক্ষে রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নির্বাচনী এলাকায় লেমিনেটেড কোনো পোস্টার টানাতে পারবে না। যত্রতত্র পোস্টার টাঙাতে পারবেন না; পোস্টার সেঁটে দেয়ার জন্য কমিশন ২১টি জায়গা নির্দিষ্ট করে দেবে। সেখানেই পোস্টার সাঁটানো যাবে। তবে প্রার্থীরা নির্বাচনী ক্যাম্পে পোস্টার টাঙাতে পারবেন।

প্রচারণায় কোনো জনসভা করা যাবে না। প্রত্যেক প্রার্থী ৫টি শোভাযাত্রা বের করতে পারবেন। এর আগে পুলিশ ও রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে স্থান নির্ধারণ করতে হবে।

গত ১০ দিন এসব শর্ত মেনে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। তবে গতকাল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে পোস্টার লাগানোর অভিযোগ করেছেন বিএনপির প্রার্থী।

এ ছাড়া সমঝোতা অনুযায়ী, ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকায় কোনো সাধারণ ছুটি থাকবে না। মোটরসাইকেল ছাড়া অন্য সব যান চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-১০ ও আরও দুই আসনের উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর। তফসিল অনুয়ায়ী আগামী ২১ মার্চ ভোট নেওয়া হবে। এই তিন আসনের মধ্যে কেবল ঢাকা-১০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে।

অন্য দুটি আসন হলো গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪ আসন। এই দুই আসনের সাংসদদের মৃত্যুতে এগুলো শূন্য হয়।