ব্যক্তিগত,পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মাশওয়ারা বা পরামর্শের গুরুত্ব অপরিসীম। পরামর্শের মাধ্যমে ঐক্য ও পারস্পরিক ভালোবাসা সুদৃঢ় হয়।
সম্মিলিত চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণের কারণে সহজ ও উত্তম সমাধান বেরিয়ে আসে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়।
আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দিয়েছেন , হে নবী, (গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে) আপনি তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন! ( সুরা আলে ইমরান,আয়াত: ১৫৯)
প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত পড়লে জানা যায়, তিনি পরামর্শ করে কাজ করাকে কতো গুরুত্ব দিয়েছেন।
শুধু জটিল ও কঠিন বিষয়েই নয়, অতি সাধারণ বিষয়েও তিনি সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। এতে যেমন সবার মন রক্ষা হয়, তেমনি প্রভূত কল্যাণও অর্জিত হয়। পরামর্শ করে কাজ করলে সহকর্মীদের মধ্যে সেই কাজের গুরুত্ব ও গতির সঞ্চার হয়।
হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় মক্কার কাফের সম্প্রদায় যখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ১৪০০ সাহাবিদের মক্কায় প্রবেশ করতে বাঁধা দিল এবং সাফ জানিয়ে দিল, এবছর মক্কায় প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই, রাসূল (সা.) তখন সাহাবিদের কোরবানী ও হলক (মাথা মুণ্ডন) করতে নির্দেশ দিলেন।
কিন্তু তারা এতো সহজে কাফেরদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাঁধ সাধলেন।
তাদের মনে ক্ষোভ ছিল, মদিনা থেকে এতো কষ্টকরে, এতো দূরের উক্তপ্ত মরুভূমির পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় এসেছি কাবাদর্শনে, দয়াময় প্রভুর পবিত্র ঘরের সান্নিধ্য অর্জনে , সেই উদ্দেশ্য পূরণ না করেই অবাধ্য কাফের-মুশরিকদের কথায় কিনা পথ থেকেই মদিনায় ফিরে যাব!
এটা হতেই পারে না; এই কথা ভেবে তারা নবিজীর নির্দেশ পালন করতে বিলম্ব করছিলেন। এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের প্রতি কিছুটা বিরক্ত ও রাগান্বিত হলেন।
উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালামা (রা.) ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন এবং রাসূলকে পরামর্শ দিলেন, আপনি নিজে আগে কোরবানী ও হলক করে ফেলেন ; তখন আপনার সাহাবিরা আপনার কথার অন্যথা করতে পারবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হযরত উম্মে সালামার পরামর্শ খুব পছন্দ হল এবং তিনি তা বাস্তবায়নও করলেন। যখন সাহাবিরা নিজেদের প্রাণাধিক প্রিয় রাসূলকে দেখলেন, তিনি কোরবানী ও হলক করে ফেলেছেন, তখন আর তারা বিরত থাকতে পারলেন না।
ইসলামি খেলাফত বা রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার মৌলিক বিষয়াদির অন্যতম বিষয় হল পরামর্শকরণ। হযরত ওমর (রা.) বলেন, পরামর্শ ব্যতিত খেলাফত হতে পারে না। ( কানযুল উম্মাল) তার মানে পরামর্শকে ইসলামে কতো গুরুত্ব দেয়া হয়েছে!
ইসলামি শাসক কখনও যদি পরামর্শের উর্ধ্বে চলে যান, কিংবা এমন লোকদের সঙ্গে পরামর্শে প্রবৃত্ত হন, যারা পরামর্শ প্রদানের যোগ্য নয়, তাহলে ইসলামি বিধান অনুসারে তাকে শাসনকার্য থেকে অপসারণ করা আবশ্যক। ( তাফসীরে আনোয়ারুল কুরআন, পৃষ্ঠা: ৫৪৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শকে ‘রহমত’ বলে অভিহিত করেছেন।
ইবনে আদী ও বায়হাকী (রহ.) হযরত ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলের জন্য পরামর্শ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না, (কারণ ,তার কাছে ওহি আসত। তবুও তিনি পরামর্শ করতেন;) যেহেতু উম্মাতে মোহাম্মাদির জন্য পরামর্শকে রহমত সাব্যস্ত করা হয়েছে। (বায়ানুল কুরআন)
খতিবে বাগদাদি বর্ণনা করেন, হযরত আলী (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার অবর্তমানে আমরা যদি এমন কোনো বিষয়ের সম্মুখীন হই, যার সমাধান কোরআন ও হাদিসে নেই, তখন আমরা কী করব?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, আমার উম্মতের এবাদাতগুজার বান্দাদের জমা করবে এবং করণীয় কী হবে, পরামর্শ করে তা স্থীর করে নিবে। কোনো ব্যক্তিবিশেষের ফায়সালা প্রাধান্য দিবে না।
হযরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো কাজ করার জন্য পরামর্শ করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সঠিক ও সহজ পথ প্রদর্শন করেন। (বায়হাকী)
পঞ্চম হিজরিতে ইহুদি গোত্র বনু নাযির মদিনা থেকে বেরিয়ে খায়বার গিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে। সেখানে বসে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানাবিধ কূটকৌশল করতে থাকে। তাদের সরদাররা মক্কার কোরাইশদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে জোট বাধে।
বনু গাতফান,বনু আসাদ, বনু সুলাইম ও বানু সাদ, মোটকথা আরবের সমস্ত গোত্র ১০ হাজার সৈন্যসামন্ত নিয়ে যখন মদিনা আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ পেয়ে পরামর্শসভা ডাকলেন। বড় বড় সাহাবিরা উপস্থিত হলেন। একেকজন একেক পরামর্শ দিলেন।
ইরানের অধিবাসি হযরত সালমান ফার্সি রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, অনুমতি হলে আমি আমার মতামত পেশ করতে চাই! নবীজি অনুমতি দিলেন।
সালমান ফার্সি রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, খোলা প্রান্তরে গিয়ে শত্রুসেনাদের সঙ্গে মোকাবিলা করা উচিত হবে না। আমরা বরং নিরাপদ ও সুরক্ষিত স্থানে সমস্ত সাহাবিদের একত্রিত করে চারপাশে খন্দক (পরিখা) খনন করতে পারি।
যুদ্ধবর্তী সময়ে তার এমন সুপরামর্শে নবিজী খুব খুশি হলেন। সমস্ত সাহাবী তার পরামর্শ পছন্দ করলেন এবং তাতে সম্মতি ব্যক্ত করলেন।
কোনো কাজ করার আগে পরামর্শ করলে যে সবার মধ্যে উদ্যমতা ও গতির সঞ্চার হয়, তার উদাহরণ টানতে গিয়ে বিখ্যাত তাফসিরবিদ ইবনে কাসীর (র.) বলেন, যখন ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল, তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শ করতে বসলেন এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে সবার মতামত জানতে চাইলেন।
সঙ্গে সঙ্গে হযরত সা’দ ইবনে মুআজ রাযিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে গেলেন। দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, আমি আনসারদের পক্ষ থেকে দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি, হে আমাদের প্রাণের নবী, আপনি যেখানে ইচ্ছে সফর করুন, যার সঙ্গে ইচ্ছে সম্পর্ক স্থাপন করুন কিংবা ছিন্ন করুন, আল্লাহর শপথ- আপনি যদি বারকুল গিমাদেও যেতে চান, আমরা আপনার সঙ্গে আছি।
শুধু তা-ই নয়, আপনি যদি আমাদের নিয়ে এই গভীর সমুদ্রেও ঝাপ দিতে চান, নির্দ্বিধায় আমরা আপনার সঙ্গে তাতে ঝাপিয়ে পড়ব।
এছাড়াও পরামর্শের মাধ্যমে আরও অনেক সুফল পাওয়া যায়।
পদ্ধতি হল, যে যে বিষয়ে বিজ্ঞ, তার সঙ্গে সে বিষয়ে পরামর্শ করা। কেউ কোনো ব্যবসা আরম্ভ করতে চাচ্ছেন, যারা এমন ব্যবসা করেছেন বা করছেন,তাদের কাছ থেকে এসম্পর্কে আদ্যোপান্ত জেনে নেয়া, পরামর্শ করা।
সন্তানকে মাদ্রাসা বা স্কুলে পড়াতে চাচ্ছেন, তাহলে আগে আলেম এবং শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করা। কোথায় পড়াবেন, কোন মাদ্রাসা বা বিদ্যালয়ে পড়াবেন, এগুলো আগে বিজ্ঞ কারও কাছ থেকে জেনে নেয়া।
বিদেশভ্রমণে যেতে চাচ্ছেন,আগে যারা সেদেশে গিয়েছেন, এখনও অবস্থান করছেন, তাদের কাছ থেকে ভালোমন্দ, সুবিধা-অসুবিধার ব্যাপারগুলো জেনে নেয়া। পরামর্শ করা। এগুলো কেবল রীতিনীতিই নয়, সুন্নাতও।
পবিত্র কোরআনের সুরা শুরার মধ্যে মোমিনের সিফাত এবং গুণাবলির আলোচনায় এসেছে, ‘তারা এমন যে,পরস্পরের কার্য সমাধা করে পরামর্শের ভিত্তিতে’। তারমানে মোমিনমাত্রই পরামর্শপরায়ন হবে।
অনেকে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করাকে দোষের বিষয় মনে করে। এটা ঠিক নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লামও তার স্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।
মনে রাখতে হবে, আমি যার সাথে পরামর্শ করছি, তিনি যেই মতামত দিয়েছেন, সেটাই আমাকে মানতে হবে-এটা জরুরি নয়।
পরামর্শ আমি অবশ্যই করব, সবার মতামত গ্রহণ করব, কিন্তু আমার কাছে যে সিদ্ধান্ত বেশি শুদ্ধ এবং ভালো মনে হবে, সেই মোতাবেক কাজ করাতে কোনো অসুবিধা নেই। এটা দোষের কিছু নয়।