হঠাৎ বৃষ্টি। সোমবার রাতে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে বাগড়া। ঝুম বৃষ্টি চললো ঘণ্টা খানেক। তারপর মিহিরগুঁড়ো আরও কিছুক্ষণ। বৃষ্টির তোড় কিছুটা কমে এলে বেরুলাম। অফিসের পাশে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সমানের রাস্তার অর্ধেকটা পানির দখলে। চরের মতো জেগে থাকা বাকিটুকু দিয়েও হাঁটতে হচ্ছে রয়েসয়ে। একটু পর পর পেছন থেকে গাড়ির বাতি আর হর্ন একসঙ্গে বেজে উঠছিল। এই পথে পায়ে হাঁটা দায়। বুঝলাম। চড়ে বসলাম রিকশায়।
হাতিরঝিলের যে পথটা দিয়ে প্রতিদিন বাড়ি ফিরি, ঢুকতেই সেখানে সামান্য জটলা। কী হয়েছে? কিছুদূর এগোতে চোখে পড়ল। একটা বড় কাভার্ড ভ্যান আটকে দিয়েছেন রঙজ্বলা লাল পোশাকের প্রহরী। চালকের সঙ্গে বচসা। এই পথে যেতে দেওয়া যাবে না। চালকের অনুনয়, ‘এবার ছাড়েন, আর আসুম না’। প্রহরী ততটাই নাছোড়, ‘ঘুইরা যান। ছাড়তে পারুম না।’
এই বিতণ্ডা প্রায়ই রাস্তায় চোখে পড়ে। ভিআইপিতে রিকশা ঢুকলে আনসার সদস্য তেড়ে আসেন। গাল দেন। রিকশাচালক বয়সে যেমনই হন, তুই-তুকারি শুনতেই হবে। আবার অনেক সময় চালক পকেট থেকে কী একটা বের করে হাতে গুঁজে দিলে সেই তারাই কেমন চুপ হয়ে যান! আমি দেখি। অবাক হই। কত রকমের ভাষা যে আছে এই শহরে। মুখ দিয়ে না বলেও অনেক অসাধ্য সাধন হয়। কেবল ওই ভাষার গুণে।
সে যাই হোক। কভার্ডভ্যান চালক আর নিরাপত্তা প্রহরীর বচসায় মন বসলো না। ওদিকে ঘড়ির কাঁটা পৌনে এগারোতে গিয়ে বারবার বলছে, ‘কী হলো? হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস তো বন্ধ হয়ে এল।’ ছুটলাম কাউন্টারে। চোখের সামনে বাস চলে গেল। নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল। কেন ওখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করলাম! ফিরে আসছিলাম। কাউন্টারের এক কর্মী বললেন, ‘দাঁড়ান। আর একটা আছে।’
হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস মিললেও ‘ঢাকা চাকা’ অনেক আগেই পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়ি ফিরেছে। রাত দশটার পর হাতিরঝিলের পুলিশ প্লাজা থেকে গুলশানে যাওয়ার কোনো গণপরিবহন নেই। হয় সিএনজি অটো ডাকতে হবে। নয়তো রাইড শেয়ারিং উবার-পাঠাও। দুটোই বেশ খরচে। করার কিছু নেই। অগত্যা বুলাতে হলো উবার। ‘ঢাকা চাকা’ বাসে যে পথ যাওয়া যায় ১৫ টাকায় সেই পথের ভাড়া ৯২ টাকা! রাত এগারোটা পার হয়েছে। এখন আর এসব ভেবে কী হবে। যেতে হবে। এটাই কথা।
আমি যেখানটায় থাকি, সেখানে যেতে পার হতে হয় গুলশানের দুটো চেকপোস্ট। প্রথমটি গুলশান-২ নম্বর চত্বর পার হয়ে। গুলশান থানার কিছু আগে। দ্বিতীয়টি ইউনাইটেড হাসপাতালের পেছনে বারিধারা ডিওএইচএসের মূল ফটকের সামনে। এই চেকপোস্টটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আসতে-যেতে দুবারই চেক করা হয়। সবাইকে নয়। যাকে সন্দেহ হয় তাকে।
রাত ১১টার পর ওই চেকপোস্ট দিয়ে কোনো যানবাহন যেতে দেওয়া হয় না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে পুলিশ সদস্যদের অনুরোধ করা যায়। অনুরোধ যে সব সময় গৃহীত হয়, তাও নয়। মাঝেসাঝে পার হওয়া যায়।
সোমবার রাতে সেখানে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে ১১টা ২০। অস্থায়ী বেরিকেডের ফাঁক গলে ওপাশ থেকে একটা মোটরসাইকেল পার হয়ে এল। দেখে উবারচালক ভাইটিরও সাহস হলো। দোনোমোনো করতে করতে তিনিও পার হতেই থামানো হলো তাকে। পুলিশের এক সদস্য হাত উঁচিয়ে ইশারা করলেন বাইকটা একপাশ করে রাখতে। চালক ইশারায় সাড়া দিলেন।
পুলিশের হাবভাবে যতটুকু বোঝা গেল চালকের মুখ দেখে সন্দেহ হয়েছে। তাকে তল্লাশি করা হবে। শুরু হলো তল্লাশি। একে একে পকেট থেকে সবকিছু বের করলেন চালক। আমি তখন পেছনে দাঁড়ানো। পুলিশ সদস্য হাতের টর্চের আলো ফেলে চালকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিলেন। তারপর দাঁতের ফাঁকে টর্চটা আটকে দু-হাতে প্যান্টের পকেটের ওপরে, কোমর, কলারের ভাঁজ, জুতোর তলায় চেক করলেন।
এক পর্যায়ে চালকের কাঁধে থাকা ছোট্ট ব্যাগটিতে হাত চালিয়ে বের করে আনলেন গাড়ির কাগজপত্র, চালকের লাইসেন্স। আরেক পকেটে ভাঁজ করা কাগজ। এগুলো রেখে দিয়ে ছোট্ট একটি পকেটে হাত দিলেন। বের করে আনলেন দুই টাকার একটা নতুন নোট। ভাজ করা। টাকাটি মেলে খানিকক্ষণ আলোয় ধরলেন। এপাশ-ওপাশ উল্টে দেখলেন। শেষে টাকাটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতে শুরু করলেন আর্মড পুলিশের ওই সদস্য।
টাকা শোঁকা শেষে তিনি মুখ তুললেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি যান। উনি থাকুক। ভাড়া মিটিয়ে চলে এলাম। মিনিট দশেক পর উবারের চালক ভাইকে ফোন দিলাম। ‘কী সমস্যা হয়েছিল ভাই?’
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, ‘সমস্যা না। আপনি আসার পরপরই ছেড়ে দিছে।’
‘তাহলে এত সময় নিলো কেন?’
‘টাকা দেখে সন্দেহ হয়েছিল তাদের।’
উৎসুক মন। বললাম, ‘কী সন্দেহ?’
চালক বললেন, ‘কী আর। ইয়াবাসেবীরা তো মাদক নিতে দুই টাকা, পাঁচ টাকার নোট ব্যবহার করে। ভেবেছিল আমিও তেমন কিছু করি কি-না।’
‘যাক। হয়রানি থেকে বাঁচলেন।’
চালক বললেন, ‘এখন তো দেখি টাকাও শুঁকে নিতে হবে। টাকা তো হাতে হাতে ঘোরে। মাদকসেবনেরটাও তো হাতে আসতে পারে, কী বলেন?’
আমি বললাম, ‘ভুল বলেননি। এতদিন ছিল জাল টাকার ভয়। দেখে নিলেই হতো। এখন শুঁকেও নিতে হবে!’
লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার।
mhfahad71@gmail.com