পুরানা পল্টন মোড়ে দোতলা একটি প্রাচীন ভবন পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও এর ইতিহাস কেউ জানে না। তবে ভবনের গায়ে একটি শ্বেতপাথরে লেখা আছে ‘ফ্রিম্যাসন্স হল-১৯১০’।
অনেক দিন ধরেই এই ফ্রিম্যাসন্স কথাটি নিয়ে অনুসন্ধান করতে থাকি। কিছুদিন আগে জন রিচার্ডসন বেনেটের লেখা এ-সংক্রান্ত একটি বই হাতে পাই। সে সূত্রে জানতে পারি এটা আসলে ইহুদিদের একটি ক্লাবের নাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ নামে তাদের ক্লাব রয়েছে। সেখানে তারা অবসরে মিলিত হয়ে আড্ডা, খেলাধুলা, ধর্মীয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকে।
পুরানা পল্টনের সে ভবনটি একসময় ইহুদি ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যা ছিল ঢাকাবাসীর কাছে একটি রহস্যজনক ক্লাব। ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকজন ছাড়া সে ক্লাবে কেউ প্রবেশ করতে পারত না।
পুরানা পল্টনের প্রবীণ বাসিন্দা আবুল ফিদা চৌধুরী জানান, ‘আজ থেকে ৫০ বছর আগেও পল্টনের এ ক্লাবে ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকজন ভিড় করত। ক্লাবের ভেতরে চলত তাদের আলাপ-আলোচনা, গোপন বৈঠক, খানাপিনা এবং নাচগান। তবে সব কিছুই হতো সতর্কতার সঙ্গে। বাইরে থেকে তাদের কোনো কিছুই জানা যেত না। যাঁরা এখানে আসতেন তাঁরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন না।
তবে স্থানীয় লোকজন ইহুদিদের ক্লাব মনে করে সেখানকার আশপাশে ঘেঁষতেন না। পাছে যদি কোনো ঝামেলা হয়। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর আর তাদের পল্টনের এই ফ্রিম্যাসন্স ক্লাবে খুব একটা দেখা যেত না। পরে ক্লাবটি পরিত্যক্ত ঘোষণা হলে সেখানে রমনা তহশিল অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ওই ভবনে ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।’
ঢাকা টেলিভিশনের প্রথম ঘোষক ইহুদি সম্প্রদায়ের মর্ডি কোহেন বুদ্ধদেব বসু
ওই অফিস সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর ইহুদি ক্লাবটি অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তাদের বেশির ভাগ জমিজমা দখলদারের হাতে চলে যায়। তখন ঢাকায় দু-চারজন ইহুদি বাস করলেও তাঁরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতেন।
১৯৮০ সালের দিকে তাঁদের বেশির ভাগ ইহুদিই আমেরিকা কিংবা ইসরায়েলে চলে যান। তাঁরা চলে যাওয়ার সময় তাঁদের ক্লাব এবং জমি ঢাকা ডিসি অফিসের বরাবর দলিল করে যান। সেই দলিল সূত্রে ওই ক্লাবের জমিজমা খাস ঘোষণা করা হয়েছে। সে জমি বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ অফিসের নামে লিজ নেওয়া হয়েছে।
এ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ইহুদিদের ক্লাব ফ্রিম্যাসন্স প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭২৯ সালে কলকাতার ফোর্ড উইলিয়াম দুর্গে। ১৭১৭ সালে লন্ডনে ফ্রিম্যাসন্স আন্দোলন শুরু হওয়ার মাত্র দুই বছর পর কলকাতায় এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৭৫৩ সালে মাদ্রাজে এবং ১৭৫৮ সালে মুম্বাইতে এর প্রসার ঘটে। পাকিস্তানে এর শাখা স্থাপিত হয় ১৮৫৯ সালে লাহোর শহরের আনারকলি নামক স্থানে।
১৯০৪ সালের ৪ এপ্রিল ভূমিকম্পে ক্লাবটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তা আবার নির্মিত হয় ১৯১৬ সালে। এরই মধ্যে ১৯১০ সালে ঢাকায় এর একটি শাখা স্থাপিত হয়ে যায়। লাহোর ছাড়াও পাকিস্তানের হায়দারাবাদ, কোয়েটা, মুলতান, শিয়ালকোট, রাওয়ালপিণ্ডি ও পেশোয়ারে এর শাখা গড়ে উঠেছিল। তৎকালীন সময় ওই ক্লাব এতটাই অগ্রসরমাণ ছিল যে শুধু করাচিতে এর ২০টি এবং লাহোরে তিনটি শাখা গড়ে উঠেছিল। ঢাকার পর চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরে গোপনীয়ভাবে এর কয়েকটি শাখা গড়ে উঠেছিল। এ সব শাখাই তখন ‘গ্র্যান্ড লজ অব ইংল্যান্ড’-এর অধীনে পরিচালিত হতো।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়ও ঢাকায় বেশ কিছু ইহুদি পরিবার ছিল। এসব পরিবারের সদস্যরা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা পেশায় যুক্ত ছিলেন। কেউ কেউ হোটেল-রেস্তোরাঁও চালাতেন। ঢাকার বনেদি রেস্তোরাঁর জনক হলেন ইহুদিরা। এর প্রমাণ হলো গুলিস্তান এলাকার হোটেল রিজ। কয়েকজন ইহুদি মিলে হোটেলটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখনকার সময় ঢাকায় তেমন কোনো হোটেল ছিল না। যার কারণে ইহুদিদের প্রতিষ্ঠিত সেই রিজ রেস্তোরাঁয়ই সরকারি-বেসরকারি অনেক অনুষ্ঠান হতো।
১৯৫০ সালের ১৩ আগস্ট কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু শেষবারের মতো ঢাকায় আসেন। তাঁর সৌজন্যে ইহুদিদের রিজ রেস্তোরাঁয়ই নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। ফ্রেন্ডস সার্ভিস ইউনিটের ঢাকা প্রধান টোরেন্স মিউসের আমন্ত্রণে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। মূলত তাঁদের অফিসের এক ঘরোয়া বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্যই বুদ্ধদেব বসুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁর থাকার জায়গাও করা হয় ফ্রেন্ডস সার্ভিসের একটি কক্ষে।
রিজ হোটেলটি আরেকটি কারণে কাস্টমারদের প্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছিল। সেখানে ম্যানেজারের কাউন্টারের পাশেই স্টিলের আলমিরা সাদৃশ্য একটি ফ্রিজ ছিল। তখন সচরাচর কোথাও ফ্রিজ দেখা যেত না। দু-চারটি রাষ্ট্রীয় কিংবা দেশের প্রথম পাঁচতারকা হোটেল কন্টিনেন্টালে ফ্রিজ ছিল।
যার কারণে এটি অনেকের কাছে দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। যা বুদ্ধদেব বসুর চোখও এড়ায়নি। তিনি আলমিরা সদৃশ্য ফ্রিজটি নিয়ে কবিসুলভ রসিকতাও করেন। হোটেল ম্যানেজার তাঁকে জানান যে এই যন্ত্রটির কল্যাণেই রেস্তোরাঁয় খাবার সকাল থেকে গভীর রাত অবধি টাটকা রাখা যাচ্ছে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা রিজ হোটেলটির মালিকানা পঞ্চাশের দশকে হাত বদল হয়। একই সঙ্গে তার নাম বদল হয়ে হয় ‘রেক্স’। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই রেক্স ছিল ঢাকার বনেদি বাসিন্দা ও কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থল। তখন সাদা চামড়ার বিদেশিদের আড্ডাস্থল ছিল ঢাকা ক্লাব। ঢাকা ক্লাবের বাইরে রেক্স রেস্তোরাঁ ছিল অনেকেরই আড্ডার প্রিয় জায়গা। অনেক রাত পর্যন্ত রেক্সে কবি-লেখকদের আড্ডা চলত বলে অনেকেই তাঁদের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন।
‘ঢাকাই কথা ও কিস্সা’ গ্রন্থে কাদের মাহমুদ উল্লেখ করেন, ২০১৩ সালে সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, ঢাকায় দুই শরও কম ইহুদি বসবাস করছেন। তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ঢাকাবাসী খুব একটা জানেন না। তাঁরাও পরিচয় গোপন করে ঢাকায় বসবাস করতে ভালোবাসেন।’
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ঘোষক হলেন মর্ডি কোহেন। তাঁর সহযোগী ঘোষক ছিলেন মাসুমা খাতুন। এ মর্ডি কোহেন ছিলেন ইহুদি সম্প্রদায়ের লোক। তিনি প্রথমে রাজশাহীতে রেডিওতে ঘোষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৬৪ সালে ২৫ ডিসেম্বর টেলিভিশন শুরু হলে সেখানে ঘোষক হিসেবে যোগদান করেন। দেখতে সুদর্শন মর্ডি কোহেন সহজেই টেলিভিশনের একজন জনপ্রিয় ঘোষক হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। একসময় সংবাদ পাঠক হিসেবেও তিনি আবির্ভূত হন।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর তিনি তাঁর পরিবারসহ কলকাতা চলে যান। সেখানে তিনি তপন সিংহ পরিচালিত ‘সাগিনা মাহাত’ ছবিতে অভিনয় করেন। বাংলাদেশে থাকতেও তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মর্ডি কোহেন ঢাকায় এসেছিলেন। ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি মারা যান। কলকাতার নারকেলডাঙ্গায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছে।
অন্যদিকে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য পি জি হার্টগ জন্মগতভাবে ইহুদি পরিবারের সদস্য ছিলেন। তিনি শুধু উপাচার্যই ছিলেন না, যে স্যাডলার কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশ ও প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে কমিটিরও সদস্য ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ বছর চাকরি করেছিলেন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রথম শুরু হলেও হার্টগ উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর। চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছিল ১৯২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তিনি একজন সফল উপাচার্য ও বিশ্ববরেণ্য শিক্ষাবিদ ছিলেন। সুত্রঃ কালেরকণ্ঠ