তেঁতুল হুজুর বলে বিশ্বব্যাপী পরিচিত চট্টগ্রামের মাওলানা আহমেদ শফি, হেফাজতে ইসলামীর চিরকালীন প্রধান এর দু’দিনের সাম্প্রতিক বক্তব্যে বাঙালি জাতি নিঃসন্দেহে অনেক উপকৃত হয়েছেন। আশা করি দেশের কল্যাণ ও মঙ্গলকামী বিশেষ করে যারাই শিক্ষিত জাতি গড়তে চান তাদের সকলের কাছেই তেঁতুল হুজুরের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। কারণ উনি যথার্থভাবেই উপলদ্ধি করেছেন যে মেয়েরা সংখ্যায় অর্ধেক তাই তাদের দিকে নজর দেওয়া দরকার।প্রথম দিন তিনি পঁচিশ হাজার ভক্তের এক সমাবেশে বললেন, মেয়েদেরকে চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির উপরে পড়াবেন না। স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়তে মেয়েদের পাঠাবেন না। যদি পাঠান তবে একদিন অবশ্যই দেখবেন ঐ মেয়ে আর আপনার কাছে নেই অন্যের কাছে চলে গেছে। ঐ ২৫,০০০ লোককেই তিনি এ ব্যাপারে ওয়াদা করিয়ে ছেড়েছেন।
বস্তুত: তিনি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতিই অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি হলো মেয়েদের বিষয়। এ বিষয়ে তিনি যে যথেষ্ট গবেষণা করেন-ধারাবাহিকভাবে বিগত কয়েক বছর যাবত প্রদত্ত নারী সংক্রান্ত তার বক্তব্যগুলি একত্রে সাজালে তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে। আল্লামা তেঁতুল হুজুর, যে অসাধারণ খেতাবটি হুজুরকে মানুষ স্বেচ্ছায় উপহার দিয়েছিলো-সেটা কয়েক বছর আগের ঘটনা। সে সময় তিনি হেফাজতের ইসলামের ব্যানারে ঢাকায় বাণিজ্যিক এলাকায় (যে খানে বড় বড় ব্যাংকগুলির হেডকোয়াটারই শুধু নয় সব ব্যাংকের প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের ও হেড অফিস) কয়েক লক্ষ মানুষের বিশাল সমাবেশ আহবান করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তার আগে হেফাজতে ইসলাম নামক কোন সংগঠনের আদৌ কোন অস্তিত্ব বাংলাদেশে আছে বলে কেউ জানতো না। মনে হয় গোয়েন্দা শাখাগুলিও না।
একটি জনস্রোতে নেমে জনজোয়ারের সৃষ্টি করেছিল যেন। অত মানুষ খাবার জল, খাদ্যাদি, প্রসাব -পায়খানা করার মত জায়গা বা কোথায়। সহজেই বুঝা যায় যথেষ্ট সবক দিয়ে মানুষগুলিকে যথেষ্ট কষ্ট সহিষ্ণু করে গড়ে তোলা হয়েছিল। তাই মনে হয় তারা প্রকৃতির ডাককেও চেপে রাখতে কামিয়াব হয়েছিলেন ঐ সমাবেশে বসে। একটি কথা কিন্তু হুজুর ঠিক রেখেছিলেন। তার ঐ সমাবেশে কোন মহিলা অংশ গ্রহণ করেনি শ্রোতা হিসেবে। সব শ্রোতা সব বক্তাই পুরুষ এবং কোন না কোন কওমী মাদ্রাসার সাথে সংশ্লিষ্ট।
বিষয়টা কি কম খরচের? কোথায় পেলেন এত টাকা? এ প্রশ্নটি তখন ব্যাপকভাবেই উঠেছিল। আলহাজ্ব হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ, কাজী জাফর আহমেদ এবং সম্ভবত; একজন বিশেষ খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাও সেখানে গিয়েছিলেন তাদের সহায়তা করতে ট্রাককে ট্রাক বোঝাই নানাবিধ সামগ্রী নিয়ে এ জনসমুদ্রকে সরবরাহ করেন অনেক অনেক সওয়াবের আশায়। সে আশা তাদের, অন্তত: এরশাদের ক্ষেত্রে যে যথেষ্ট সওয়াব হয়েছে তাতে আদৌ কোন ভুল নেই। নইলে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থেকে যে পরিমাণ দুর্নীতি তিনি করেছিলেন, ১৯৯৬ এ সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই তিনি দিব্যি সাধু হওয়ার প্রক্রিয়া সুরু করেন।
তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কয়েক ডজন দুর্নীতির মামলা একে একে প্রত্যাহার হতে থাকলো। বিগত কয়েক বছরে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব দুর্নীতির মামলাই সরকার তুলে নিয়েছে। এখন মাত্র একটি মোকদ্দমা বিচারাধীন। এটির বিচার হয় না-ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে কয়েক বছর যাবত যাতে সরকারের বিরুদ্ধে যদি কখনও ফোঁস করে- তখন চালু করে ওনাকে জেলে পাঠানো হবে। এটা কি একটা কম সুযোগ? ফোঁস না করলেই মিটে গেল।
শুধু তাই না, জাতীয় নেতা-নেত্রীদের চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া, অসংখ্য মানুষকে কারাগারে আটকে রাখা, মিছিলের উপর দিয়ে সজোরে ট্রাক চালিয়ে মানুষ খুন করা সত্ত্বেও এ সকল বিষয়ে তার বিরুদ্ধে কোনদিন কোন মামলাই দায়ের হলো না। ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ তো তার গুলিতে প্রাণ দেওয়া এক যুবলীগ নেতার বুকে পিঠেই লাগানো দেখেছি। দরিদ্র ঘরের তরুণ এই আওয়ামী লীগ কর্মী আজ প্রায় বিস্মৃতি এবং দিবসটি এক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যাবসিত।যত যাই করে থাকুন না কেন তেঁতুল হুজুরের অমোঘ দোয়ায় এরশাদ আজ প্রায় মন্ত্রী পর্যায়ে সম্মানিত আসনে, গণতন্ত্রের অগ্রদূত। আর তাকে যারা আটকেছিলেন দুর্নীতির মোকদ্দমায় , তিনি গুষ্টিশুদ্ধ আজ কারাগারে। হুজুরের দোয়ার মহিমাই আলাদা।
আবার তেঁতুল হুজুরের কথা না মেনে এক মহিলা সাংবাদিক এসেছিলেন ঐ সমাবেশের নিউজ কভার করতে। ধর্ম কি তা বরদাশত করে? করে নি। তাই সেই মহিলাকে তার সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া সত্বেও রীতিমত উত্তম মাধ্যম দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হলো। তারপর বহুদিন আর ঐ মহিলার খবর জানি না তবে শিক্ষা নিশ্চয়ই হয়েছে তার। সাংবাদিকতায় তিনি আছেন কিনা তাও জানি না।আমাদের মানুষগুলো যেন কেমন! তেঁতুল হুজুরের এবারের সমাবেশে প্রদত্ত নারী সংক্রান্ত ঐ বয়ানের খবর সংবাদপত্রে পড়ে সবাই তার নিন্দা করতে লাগলো। সংবাদপত্র, ফেসবুক,অনলাইন পত্রিকা কোন কিছুই বাদ নেই। জানি না এদের গোনাহ্ কোনদিন মাফ হবে কিনা।
তবে পরদিন তেঁতুল হুজুর এক বিবৃতি দিয়ে মানুষকে অনেক স্বস্তি দিলেন। আমিও পেলাম প্রচন্ডভাবে। নিশ্চয়ই ১৭ কোটি বাঙালিও পেয়েছেন। তিনি বলেছেন যদি স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের পড়াতে হয় তবে তাদের শিক্ষককেও হতে হবে মহিলা। নিশ্চয়ই সারা দেশ এই কথায় হুজুরের প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ হবেন সারাটি জীবনের জন্য।কারণ কমপক্ষে ৫/৬ কোটি মেয়ে আমাদের দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। এদেরকে সেখানে পড়াতেই মেয়েদেরকেই হয় তবে ঐ পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণি পাস মেয়েদেরকেই তো শিক্ষক হতে হবে। তারা সহি সালামতে দিব্যি ম্যাট্রিক, আই.এ/আই.এস.সি, বিএ/বিকম/বিএসসি এবং অত:পর এম.এ. এমএসসি বা এমকম দিব্যি পাড়াবেন এবং সরকার ঐ পঞ্চম শ্রেণি পাস স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষকদেরকে ন্যায্য বা উচ্চ হারে বেতন দিতে বাধ্য থাকবেন।
এর শুভ পরিণতিটি স্পষ্ট করে বলি। কালে ক্রমে সকল মেয়েই ম্যাট্রিক, আইএ বিএ দিব্যি পাস করে থাকে কারণ পরীক্ষার খাতা তো দেখবেন পঞ্চম শ্রেণি পাস শিক্ষিকারা।শুধু কি তাই তারাই আবার ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ল, ব্যারিস্টারি ও পি. এইচ ডি প্রভৃতি সবই পড়াবেন এবং পরীক্ষার্থীরা গোল্ডেন ফাইভ পেয়ে পাসও করবেন। ফলে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যায় গড়ে তুলতে হবে। মহিলা বেকারের সংখ্যা তাতে হ্রাস পাবে-তাই না। বরং তা সম্পূর্ণ দূর হবে।এর ফলে মেয়েরা আর কোন ছেলের সাথে বাইরে কোথাও চলে যাবে না। সবাই আজীবন বাব-মা ভাই-বোনদের কাছেই থেকে যাবে। চরিত্রহীনা মেয়ে আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাই নিজ নিজ বাপের বাড়িতে থেকে যাবতীয় সাংসারিক দায়িত্ব পালন করতে পারবে। পরপুরুষরাও তাদেরকে কোথাও দেখতে পাবে না।
কিন্তু মাননীয় তেঁতুল হুজুর/আপনার সম্ভবত: একটু ভুল হয়েছে। কারণ প্রতি বাড়িতেই তো হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্বদ্যিালয় হিসেবে সরকারকে ঘোষণা দিয়ে বেতন ভাতাদি দিতে হবে কারণ তা না হলে তো কি রিকসা, কি ভ্যানে, কি বাসে বা কারও স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে-ড্রাইভার কন্ডাক্টার, হেলপাররা তো সব পুরুষ তারা যদি কোন কোর্স করে বসে। তাই প্রতিটি বাড়িকেই স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা দেওয়াই একমাত্র নিরাপদ পদক্ষেপ হতে পারে যদি আমরা সত্য সত্যই মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবি।আপনার এই মূল্যবান পরামর্শে মাননীয় তেঁতুল হুজুর, আরও একটি অসাধারণ কল্যাণ সাধিত হবে। যেহেতু কোন দিনই মেয়েরা পরপুরুষের সংস্পর্শে আসতে পাবে না-ওই দেশের জনসংখ্যাও বাড়বে না। কারণ তার ফলে আর কোন মেয়ের তো সন্তান হবে না। আমরা খাদ্য, বস্ত্র থেকে শুরু করে যা-ই উৎপাদন করবো সব রপ্তানি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হবো-যা সম্ভবত; আপনার মনের গোপন কথা।
কিন্তু বিপদও তো আছে। কড়াকড়ি যতই করা হোক, এখানে সেখানে গোপনে গোপনে কোন না কোন দুর্ঘটনা কখনও সখনও ঘটে যাওয়া বিচিত্র না। কারণ অত-কড়াকড়ি সত্বেও সৌদি আরবের মত কঠিন ধর্মরাষ্ট্রেও এ রকম দুর্ঘটনা ঘটে থাকে-যদি ও প্রমাণ পেলে অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়ে থাকে। তবুও কিন্তু থামেনি। আর আমাদের দেশে আইন থাকলেও তা কিন্তু সৌদি আরবের মত কঠোর নয়। ফলে বলা তো যায় না।ইতিমধ্যে একটা খবর পেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। দেশের প্রখ্যাত আইনবিদ, সংবিধান প্রণতা ও দেশবরেণ্য আইনজীবী ড. কামাল হোসেন একটা বেফাঁস কথা বলেছেন। তিনি আল্লামা শফি হুজুরের বিরুদ্ধে নারী অবমাননা নারী পুরুষ বৈষম্য সৃষ্টির চেষ্টা প্রভৃতি অভিযোগে মামলা দায়ের করার কথা বলেছেন। তার মত আইনবিশেষজ্ঞ তো আমি নই কিন্তু এটুকু বুঝি তিনি যদি মামলাটা সত্যিই দায়ের করেন এবং পুলিশ যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিরপেক্ষতার সাথে কাজ করেন তবে তো হুজুরকে জেলে পাঠালে কামাল সাহেবের যে নির্ঘাত দোজখবাসী হতে হবে তাতে তো বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোন কারণ নেই।
তদুপরি এবার তেঁতুল হুজুরের নাকি স্বাধীনতা পদকের মত সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। অর্থাৎ সরকারও হুজুরের পক্ষে। সে যাই হোক দেশের যত ক্ষতি হওয়ার আশংকা দেখা যাচ্ছে তাতে বলি ধর্ম নিয়ে কেউ যেন বাড়াবাড়ি না করেন।