সম্প্রতি যে ৮ জন হাফেজ- বাংলাদেশের শিশু-কিশোর হাফেজ-কারিরা আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন ও কেরাত প্রতিযোগিতায় বরাবরই সুনাম অর্জন করছে । হৃদয়কাড়া সুর ও সুমধুর তেলাওয়াত নজর কাড়ছে বিশ্ববাসীর।
তাদের অনন্য অবদানে প্রায়ই বিশ্বমিডিয়ায় শিরোনাম হচ্ছে ষোলো কোটি মানুষের ‘বাংলাদেশ’।সাম্প্রতিক সময়ে কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, ভারত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে আয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত আটজন হাফেজে কোরআনের কথা –
১. হাফেজ আবদুল্লাহ আল মামুন
গেল বছর (২০১৭) বিশ্বজয় করেছে হাফেজ আবদুল্লাহ আল মামুন। সৌদি আরবের ‘বাদশা আবদুল আজিজ আল সৌদ আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতা’য় ৭৩টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করেছে সে।
১১ অক্টোবর আয়োজিত ওই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের ৭৩টি দেশের কিশোর ও তরুণ হাফেজরা অংশ নিয়েছিল। চারটি ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। হাফেজ আবদুল্লাহ আল মামুন দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান অর্জন করে। পুরস্কার হিসেবে পায় ক্রেস্ট এবং ১ লাখ ২০ হাজার রিয়াল।
হাফেজ মামুন আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত হাফেজ কারি নাজমুল হাসান প্রতিষ্ঠিত ঢাকার যাত্রাবাড়ীর তাহফিজুল কোরআন ওয়াসসুন্নাহ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার হিরাকান্দা তার গ্রামের বাড়ি। বাবার নাম মো. আবুল বাশার।
হাফেজ মামুন এর আগেও মিশরের রাজধানী কায়রোয় ৫৫টি দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে প্রথম স্থান অর্জন করে।
২০১৬ সালে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় এবং ২০১৪ সালের জুলাই মাসে সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে।
২.হাফেজ মুহাম্মদ তরিকুল ইসলাম
আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় ১০৩টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করেছে কুমিল্লা দাউদকান্দির হাফেজ মুহাম্মদ তরিকুল ইসলাম। ২০১৭ সনের ১৫ জুন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক রাজধানী দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় ১০৩ প্রতিযোগীর সঙ্গে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সে।
সুমধুর তেলাওয়াত ও মুগ্ধকর সুরে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে সেরা বিজয়ীর খেতাব অর্জন করে তরিকুল। পুরস্কার হিসেবে পায় ২ লাখ ৫০ হাজার দিরহাম (প্রায় ৫৬ লাখ টাকা)। দুবাইয়ের ক্রাউন প্রিন্স আহমদ বিন মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
হাফেজ তরিকুল রাজধানীর মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার ছাত্র। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার মালিগাঁও গ্রামে তার জন্ম। বাবার নাম মো. আবু বকর সিদ্দিক।
তিনি অবসরপ্রাপ্ত হাইস্কুল শিক্ষক। সাত ভাইবোনের মধ্যে তরিকুল পঞ্চম। হিফজের পাশাপাশি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তরিকুল। পুরস্কারের অর্থ দিয়ে সেবামূলক কাজ ও বাবা-মাকে হজ করাতে চায় সে।
হাফেজ তরিকুল ২০১৪ সালে মাছরাঙা টেলিভিশনে ‘আল কোরআনের আলো’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয়, ২০১৫ সালে বাংলাভিশনে ‘পবিত্র কোরআনের আলো’ প্রতিযোগিতায় ষষ্ঠ, ২০১৭ সালে এনটিভিতে ‘পিএইচপি কোরআনের আলো’ প্রতিযোগিতায় পঞ্চম ও ২০১৭ সালে হুফফাজুল কোরআন ফাউন্ডেশনের ‘জাতীয় হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায়’ দ্বিতীয় স্থান লাভ করে।
৩. হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকি
বাহরাইনে শায়েখ জুনায়েদ আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৫৪টি দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করে বাংলাদেশের কিশোর হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকি। ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর কুয়েতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় ৭২টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হয় সে।
হাফেজ ত্বকির গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানাধীন ডালপা গ্রামে। ২০০০ সালের ৩১ অক্টোবর তার জন্ম। তার বাবা মাওলানা বদিউল আলম। পারিবারিক শিক্ষা শেষে ঢাকার উত্তর যাত্রাবাড়ীর ধলপুর লিচু বাগান হাফিজিয়া নূরানী মাদ্রাসায় হিফজ শুরু করে হাফেজ ত্বকি। এখানেই হিফজ শেষ করে। তারপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায় অধ্যয়ন শুরু করে।
২০১৪ সালে বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভিতে প্রচারিত ‘পিএইচপি কোরআনের আলো প্রতিভার সন্ধানে’ কেরাত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতাসহ ২০১৭ সালে হুফফাজুল কোরআন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে।
৪. হাফেজ ইয়াকুব হোসাইন তাজ
আন্তর্জাতিক কেরাত ও হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কৃতিত্ব অর্জনকারী আরেক বাংলাদেশি ক্ষুদ্র তারকার নাম হাফেজ ইয়াকুব হোসাইন তাজ। ২০১৭ সালে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল জিম টিভির কেরাত ও হিফজ রিয়েলিটি শোতে অংশ নিয়ে ২৮টি দেশের প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে কিশোর এই হাফেজ।
হাফেজ ইয়াকুব ঢাকার তানযীমুল উম্মাহ হিফজ মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। ১০ বছর বয়সি এই হাফেজের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জে। তার বাবার নাম মো. হোসাইন।
হাফেজ ইয়াকুব এর আগে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পঞ্চম স্থান লাভ করেছিল। সেবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ৯৬টি দেশের প্রতিনিধি।
৫. হাফেজ নাজমুস সাকিব
আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত হাফেজ নামজুস সাকিব একাধিকবার বিশ্ববুকে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চাতায় নিয়ে গেছে। শুরুটা ২০১২ সালে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত এশিয়া মহাদেশ কেরাত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। সেবার ২৭টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করে নাজমুস সাকিব।
তারপর ২০১৩ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় ৮৬টি দেশের প্রতিযোগীকে টপকে প্রথম স্থান অর্জন করে। ২০১৪ সালে পবিত্র মক্কায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় ৭৩ দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে। ওই বছরই ওমানের রাজধানী মাসকাটে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে।
২০১৫ সালে সুদানের রাজধানী খার্তুমে অনুষ্ঠিত আফ্রিকা মহাদেশ কেরাত প্রতিযোগিতায় ৬৫টি দেশের মধ্যে প্রথম হয়। একই বছর কাতারে অনুষ্ঠিত ১৮ দেশের মধ্যে প্রথম হয়।
২০১৬ সালে মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায়ও প্রথম স্থান অর্জন করে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করেছে এই হাফেজে কোরআন।
তার গ্রামের বাড়ি বৃহত্তর ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানাধীন ইতাইল পল্লীতে। বাবার নাম মো. আবুল কালাম আজাদ। মা সালমা বেগম। ২৯ মার্চ ২০০১ সালে তার জন্ম। ২০০৬ সালে ময়মনসিংহের আমলাপাড়া আনোয়ারা হাফেজিয়া মাদ্রাসায় তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। এ মাদ্রাসা থেকেই হিফজ শেষ করে হাফেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
২০০৮ সালে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করে বর্তমানে ঢাকার বারিধারা মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত।
৬. হাফেজ আবু রায়হান
বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারী আরেকজন হাফেজের নাম আবু রায়হান। মার্চ ’১৮-এ কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল জিম টিভির একটি রিয়েলিটি শোতে অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে সে। অনূর্ধ্ব পনেরো বছর বয়সিদের নিয়ে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জনের পাশাপাশি কেরাত প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে।
১২ বছর বয়সি হাফেজ আবু রায়হান মাত্র আট বছর বয়সে কোরআনের হাফেজ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে। খুদে এই হাফেজ নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজারে অবস্থিত মুফতি আবদুল কাইয়ুম প্রতিষ্ঠিত বল্লভদী আল ইসলামিয়া একাডেমি শিক্ষার্থী।
বড় হয়ে বিশ্বব্যাপী কোরআনের আলো ছড়াতে চায় সে।
৭. হাফেজ হেলাল উদ্দীন
পবিত্র মসজিদুল হারামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশের সুনাম বয়ে এনেছে হাফেজ মুহাম্মাদ হেলাল উদ্দীন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে মক্কায় আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বিশ্বের ৮০ দেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় স্থান অর্জন করে সে।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মক্কার আমির খালেদ আল-ফয়সাল, প্রধান বক্তা ছিলেন, পবিত্র হারাম শরিফের ইমাম আবদুর রহমান আল-সুদাইস। বিজয়ী হাফেজ মুহাম্মদ হেলাল উদ্দীনের হাতে ৭৫ হাজার সৌদি রিয়াল চেক, সনদ এবং ক্রেস্ট তুলে দেন প্রধান অতিথি।
হাফেজ মুহাম্মাদ হেলাল উদ্দিন কারি নেছার আহমাদ আন নাছিরী পরিচালিত মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদি খান উপজেলার গোবরদি বয়রাগাদী (নুরপুর) গ্রামে তার জন্ম। বাবা হাফেজ মাওলানা মো. মঈনুদ্দীন। মা আলেমা মারুফা।
৮. হাফেজ মুহাম্মদ জাকারিয়া
‘কুয়েত অ্যাওয়ার্ড’ নামে আন্তর্জাতিক কেরাত ও হিফজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনে কিশোর হাফেজ মুহাম্মদ জাকারিয়া। ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল কুয়েতের আওকাফ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ৫৫টি দেশের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক কেরাত ও হিফজ প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অর্জন করে।
প্রতিযোগিতাটি উদ্বোধন করেন কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ আল আহমাদ আল জাবের আল সাবাহ। হাফেজ জাকারিয়া ৩০ পারা কোরআন হিফজ গ্রুপে চতুর্থ স্থান অর্জন করে ৭ হাজার কুয়েতি দিনার ও সম্মাননাপত্র লাভ করে। কুয়েতে অনুষ্ঠিত কোনো প্রতিযোগিতায় প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এটাই সর্বোচ্চ সফলতা।
এর আগে ২০১৫ সালের এপ্রিলে মিশরের কায়রোয় আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে ৫০ হাজার পাউন্ড জিতে নেয় হাফেজ মুহাম্মদ জাকারিয়া।
একই বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক শহর দুবাইয়ে আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় ৮০টি দেশের প্রতিযোগীকে হারিয়ে তৃতীয় ও সুর ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান লাভ করে। এছাড়াও কাতার, জর্ডান ও মিশরের কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে জাকারিয়া।
হাফেজ জাকারিয়ার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ। তার বাবা হাফেজ মাওলানা ফয়েজ উল্লাহ মানিকগঞ্জ হরিরামপুরের একটি মসজিদের ইমাম।
হাফেজ জাকারিয়ার সাফল্যের যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলাভিশন আয়োজিত হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করার মধ্য দিয়ে। সেবার দেশের বাছাইকৃত প্রায় ৩০ হাজার হাফেজের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার পায় সে।