মাহফুজ রহমান। মিরপুর এলাকার শেওড়াপাড়ায় একটি ভাড়াবাসায় থাকেন দেড় বছরের কিছু বেশি সময় ধরে। আসছে নতুন বছর। এই বিষয়টি সামনে রেখে ইততোমধ্যে বাসার মালিক তাকে জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী মাস থেকে ১ হাজার টাকা ভাড়া বাড়বে। তিনি বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ বিল বাদে ১১ হাজার টাকায়। আগামী মাস থেকে ভাড়া বৃদ্ধির কারণে তাকে দিতে হবে ১২ হাজার টাকা।
এসব কারণেই রাজধানীর মানুষের কাছে বাড়িভাড়া এখন যন্ত্রণার আরেক নাম। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর এলেই আতঙ্কে থাকেন ভাড়াটিয়ারা। কারণ মৌখিক নোটিশে তাকে জানিয়ে দেয়া হতে পারে, আগামী মাস থেকে বাসাভাড়া বাড়বে। এমনিতেই বাড়িভাড়ার চাপে চ্যাপ্টা হয়ে থাকেন রাজধানীবাসী।
প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছেন কর্মসংস্থান কিংবা নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। অথচ এত মানুষের বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। বেশিরভাগ মানুষের আশ্রয়স্থল ভাড়া বাসা। তাই বছরও ঘুরছে বাড়িভাড়াও বাড়ছে। বছরের পর বছর ধরে রাজধানীতে বাড়িভাড়ায় নৈরাজ্য চলছে।
প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাসের এই ঢাকার এক হিসাব মতে, রাজধানীতে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়াবাসায় বসবাস করেন। এদের বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যআয়ের জনগোষ্ঠী। মোট আয়ের সিংহভাগ বাড়িভাড়ায় চলে যায় তাদের। ভাড়াটেদের চাহিদা কাজে লাগিয়ে বাড়ির মালিকেরা ভাড়া বাড়িয়েই যাচ্ছেন প্রতিবছর।
শহিদুল হক একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোড-সংলগ্ন একটি ভাড়াবাসায় থাকেন। বাসাভাড়ার নৈরাজ্য নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে বাসাভাড়া। আমি নিজে ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি। যার মধ্যে মাসের শুরুতেই সবমিলিয়ে বাসার মালিককে দিয়ে দিতে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার টাকা। যার মধ্যে সাড়ে ১৩ হাজার বাসাভাড়া, বাকিটা বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ আনুষঙ্গিক বিল। পরিবার পরিজন নিয়ে বাকি সাড়ে ১৪ হাজার টাকায় আমাকে চলতে হয় পুরো মাস। এই টাকা দিয়ে সংসার চালানো একেবারেই কষ্ট হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘এর চেয়ে কম ভাড়ায় সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী কোনো বাসা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে প্রতি বছর ভাড়াবাড়াতে থাকেন বাসার মালিকরা। রাজধানীতে যারা কাজের স্বার্থে বসবাস করেন তাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার কারণ অতিরিক্ত বাসাভাড়া। যা দিন দিন বাড়ছেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না।’
শুধু তাই নয়, এর চেয়ে আরও বেশি কষ্টে আছেন নিম্নআয়ের মানুষরা। রাজধানীর মিরপুরের একটি বস্তিতে পরিবার নিয়ে থাকেন হামিদুর রহমান। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানির নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। হামিদুর রহমান বলেন, ‘সবমিলিয়ে বেতন পাই ১২ হাজার টাকা। স্ত্রী ও এক শিশুসন্তান নিয়ে এখানে একটি রুম নিয়ে থাকি, যার ভাড়া ৪ হাজার টাকা। বাকি থাকে ৮ হাজার টাকা। এটা দিয়েই খেয়ে-পরে মাস চালাতে হয়। এ ছাড়া অসুখ-বিসুখ, সন্তানের পড়ালেখার খরচ তো আছেই।’
তিনি বলেন, ‘বস্তির একটি রুমের ভাড়াও যদি ৪ হাজার টাকা হয় তাহলে আমাদের মতো গরিব মানুষ থাকবে কোথায়? যেহেতু কাজের আশায় সবাই রাজধানীতে চলে আসে, তাই মানুষের এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে বাসা-বস্তি মালিকরা ভাড়া বাড়িয়ে মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে।’
এ বিষয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, ‘নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাজধানীর বাসার মালিকরা প্রতিবছর ভাড়া বাড়িয়ে যাচ্ছেন। ভাড়াটিয়াদের বাসার প্রতি চাহিদা দেখে বাসা মালিকরা যেমন ইচ্ছে তেমন আচরণ করে যাচ্ছেন ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে।’
তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে লাগামহীনভাবে বাসাভাড়া বৃদ্ধি রোধে প্রয়োজন আইনের প্রয়োগ। সেই সঙ্গে সিটি কর্পোরেশন বাসাভাড়া নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং শুরু করা উচিত। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। মানুষের কষ্টে উপার্জিত আয়ের সিংহভাগই মাসের শুরুতে বাসা মালিকদের হাতে তুলে দিতে হয়, আর এই ভাড়াও যদি বছর বছর বাড়তে থাকে, তাহলে মানুষের ওপর আরও অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। এই নৈরাজ্যের অবসান ঘটানো না গেলে ভাড়াটিয়াদের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে।’
রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার একটি বাসার মালিক সাজ্জাত হোসেন। বাসাভাড়া বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘রাজধানীর বেশিরভাগ বাসা মালিকদের আয়ের প্রধান উৎস এই বাসাভাড়া থেকে। এসব বাসায় যারা ভাড়া থাকেন তাদের সবারই বছরে আয় বাড়তে থাকে, বেতনে ইনক্রিমেন্ট হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, জীবনে চলার খরচ বাড়ে, তাই বেতন বা আয়ও বাড়ে। আর আমরা বাসা মালিকরাও তো সমাজের মানুষ, আমাদের আয়ের উৎস এই বাড়িভাড়াই। তাই সময়ের চাহিদা বিবেচনা করে আমাদেরও বাসাভাড়া বাড়াতে হয়।’
অভিযোগ রয়েছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়ির মালিকরা বাড়তি বাড়িভাড়া চাপিয়ে দেন ভাড়াটিয়াদের কাঁধে। ১৯৯১ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণে একটি আইন প্রণয়ন করা হলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে উল্লেখ আছে, কোনো বাড়ির ভাড়া দুবছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে না। বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার কাছে জামানত বা কোনো অর্থ দাবি করতে পারবেন না। প্রতি মাসে অবশ্যই ভাড়া নেয়ার রসিদ দিতে হবে, তা নাহলে বাড়িওয়ালা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।