এ পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বেশি পেরেশানি হলো খাবার নিয়ে। এছাড়া মানুষ সমাজে নিজে সব চেয়ে বড় করে তুলে ধরে সম্মানের পাত্র হতে চায়। অথচ এ দুটি জিনিসেরিই মালিক মহান আল্লাহ। পবিত্র কোরআনের সূরা সাবার ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ‘বল, আমার প্রতিপালক তো তাঁহার বান্দাদের মধ্যে যাহার প্রতি ইচ্ছা রিজিক বর্ধিত করেন এবং যাহার প্রতি ইচ্ছা সীমিত করেন। তোমরা যাহা কিছু ব্যয় করিবে তিনি তার প্রতিদান দিবেন। তিনিই শ্রেষ্ঠ রিজিকদাতা।’
আল্লাহ জীবিকা বা রিজিকের মালিক। তিনিই মানুষকে রিজিক দেন। উপরোক্ত আয়াতে যে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে সেটি হলো আল্লাহ ইচ্ছা করলেই যে কোনো ব্যক্তির রিজিক বাড়িয়ে দিতে পারেন, তেমনি তিনি তা কমিয়ে দিতেও পারেন। আল্লাহ যেহেতু মানুষকে সম্পদ দেন, সেহেতু মানুষ যদি আল্লাহর নির্দেশিত পথে সে সম্পদ ব্যয় করে তবে তিনি বান্দাকে তার বিনিময় দান করার ব্যাপারেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আল্লাহ ইচ্ছা করলেই যে কাউকে পর্যাপ্ত রিজিক দিতে পারেন। সব মানুষের জন্য পর্যাপ্ত রিজিকের ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের নির্ভরতার সম্পর্ক নষ্ট হতো। মানুষের মধ্যে একে অপরকে তোয়াক্কা না করার মনোভাব দেখা দিত। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে সূরা আশ-শুরার ২৭ নম্বর আয়াতে। ইরশাদ করা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাহার সকল বান্দাকে জীবনোপকরণে প্রাচুর্য দিলে তাহারা পৃথিবীতে অবশ্যই বিপর্যয় সৃষ্টি করিত, কিন্তু তিনি তাহার ইচ্ছামতো পরিমাণেই নাজিল করিয়া থাকেন। তিনি তাহার বান্দাদিগকে সম্যক জানেন ও দেখেন।’
পবিত্র কোরআনের উপরোক্ত আয়াতের ভিত্তিতে বলা যায়, পৃথিবীর সব মানুষকে পর্যাপ্ত রিজিক ও নেয়ামত দেওয়া হলে ধন-সম্পদ প্রাচুর্যের কারণে কেউ কারও মুখাপেক্ষী থাকত না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মানুষের ধন যত বাড়ে লোভ-লালসা তত বাড়ে। ফলে সবাই পর্যাপ্ত ধন-সম্পদের মালিক হলে পারস্পরিক রেষারেষি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব বেড়ে যেত। আল্লাহর প্রদত্ত ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থার কারণে ধনীরা যাদের সম্পদ নেই তাদের কাছেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুখাপেক্ষী থাকে। আবার যাদের সম্পদ নেই ধনীদের সঙ্গে তাদেরও মুখাপেক্ষিতা গড়ে উঠেছে। আল্লাহ রিজিকের মালিক বিধায় পাথরখণ্ডের মধ্যে বসবাসকারী ক্ষুদ্র পতঙ্গের ক্ষুধাও তিনি নিবারণ করেন।
ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে তিনি যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন তা কেবল অলৌকিক সত্তার পক্ষেই সম্ভব। তাই জীবিকার জন্য অযথা অস্থিরতা কাম্য নয়। সবাই তার বরাদ্দকৃত সময় ও জীবিকা শেষ করেই দুনিয়া থেকে বিদায় হবে। ইবনে আদম দুনিয়ায় আসার আগেই আল্লাহ তায়ালা তার জীবিকা লিখে রেখেছেন। ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকে তার মায়ের পেটে ৪০ দিন শুক্র হিসেবে থাকে।
অতঃপর রক্তপিন্ড হয়ে থাকে। অতঃপর মাংসপি রূপান্তরিত হয়। এরপর তার কাছে ফেরেশতা পাঠানো হয়, সে তার মাঝে রুহ প্রবেশ করে আর তাকে চারটি বিষয় লিখে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়- জীবিকা, তার সময় বা বয়স এবং সে কি সৌভাগ্যবান না দুর্ভাগ্যবান।’ (বোখারি মুসলিম)। কিছু আমল রয়েছে, যা রিজিক বাড়ায়। জীবিকার ক্ষেত্রে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এর শিক্ষা দিয়েছেন। শরিয়ত এসব আমলের ব্যাপারে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। এসব আমলের মাঝে সর্বপ্রথম হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করা। যে আল্লাহকে ভয় করবে, তাকওয়া অর্জন করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে এমনভাবে রিজিক দান করবেন যে, সে তা ভাবতেও পারবে না।
আর আল্লাহ তায়ালার অঙ্গীকার সত্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য নিষ্কৃতির পথ করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।’ (সূরা তালাক : ২-৩)। এমনভাবে তাকে জীবিকা দান করবেন যে, সে ধারণাও করতে পারবে না। যে জায়গার ব্যাপারে তার আশা-প্রত্যাশাও ছিল না। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারি অবলম্বন করত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানি ও পার্থিব নেয়ামতগুলো উন্মুক্ত করে দিতাম।’
(সূরা আরাফ : ৯৬)। বান্দা তার পালনকর্তাকে ভয় করবে গোপনে এবং প্রকাশ্যে। ভয় করবে তার নিজের ক্ষেত্রে, তার পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ, কাজকর্ম ও তার সব কাজের ক্ষেত্রে। রিজিক বাড়ে এমন আমলের মধ্যে আরেকটি হচ্ছে, অধিক পরিমাণে এস্তেগফার পড়া এবং তা নিয়মিত করা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী নুহ (আ.) এর কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘অতঃপর বলেছি, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা প্রার্থনা করো।
তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দেবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন।’ (সূরা নুহ : ১০-১২)। অন্যদিকে হুদ (আ.) এর কথা বলতে গিয়ে এরশাদ করেন, ‘আর হে আমার কওম! তোমাদের পালনকর্তার কাছে তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো, অতঃপর তারই প্রতি মনোনিবেশ করো; তিনি আসমান থেকে তোমাদের ওপর বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদের শক্তির ওপর শক্তি বৃদ্ধি করবেন, তোমরা কিন্তু অপরাধীদের মতো বিমুখ হইও না।’ (সূরা হুদ : ৫২)।
হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি অধিক পরিমাণে এস্তেগফার পড়বে আল্লাহ তায়ালা তাকে সব দুশ্চিন্তা ও সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে মুক্ত করে দেবেন এবং ধারণাতীতভাবে তাকে জীবিকা দান করবেন।’ (আবু দাউদ)। কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘এতে বোঝা যায়, এস্তেগফারে রিজিক বাড়ে এবং বৃষ্টি বর্ষিত হয়।’ জীবিকার প্রধান একটি বিষয় হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার ওপর যথাযথ ভরসা করা। হৃদয় মাওলার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। সব ক্ষেত্রে তাঁর কাছেই সমর্পণ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করবে, সে তার সব প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট এবং তার সব অকল্যাণ ও ক্ষতিকর বিষয় তিনি প্রতিহত করবেন এবং ধারণাতীতভাবে তাকে জীবিকা দান করবেন। হাদিসে এসেছে, ‘যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালার ওপর সঠিক ও যথাযথভাবে ভরসা করো, তাহলে তিনি তোমাদের পাখির মতো জীবিকা দান করবেন, ক্ষুধার্ত অবস্থায় সবাই বের হয় আর পেটপূর্তি করে বিকালে বাসায় ফিরে।’ (আহমাদ, তিরমিজি)।
ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘তাওয়াক্কুল ও ভরসার ক্ষেত্রে হাদিসটি মূলনীতি হিসেবে গৃহীত। আর তাওয়াক্কুল ও ভরসা জীবিকার বিভিন্ন আমল ও মাধ্যমের অন্যতম।’ পূর্বসূরিদের অনেকে বলতেন, ‘আল্লাহর ওপর ভরসা করো তাহলে কোনো কষ্ট-ক্লেশ ছাড়াই তোমার রিজিকের ব্যবস্থা হবে।’ এক্ষেত্রে একটি বিষয় ভালো করে জানা প্রয়োজন যে, মাধ্যম গ্রহণ করা বা কোনো কিছু পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা তাওয়াক্কুল বা ভরসার পরিপন্থী নয়, বরং জ্ঞানী আলেম-ওলামারা বলেন, প্রচেষ্টা করা এবং মাধ্যম গ্রহণ করাই হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য। আর হৃদয় দিয়ে ভরসা করা তার প্রতি ঈমানের নামান্তর।
আর মাধ্যম গ্রহণ করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব তোমরা তার কাঁধে বিচরণ করো এবং তার দেয়া রিজিক আহার করো।’ (সূরা মুলক : ১৫)। ‘কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে।’ (সূরা মুজ্জাম্মিল : ২০)। ওমর (রা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন জীবিকার সন্ধান না করে বসে বসে এ কথা না বলে, হে আল্লাহ আমাকে রিজিক দাও, কারণ তোমরা জান আকাশ কখনও স্বর্ণ-রুপা বর্ষণ করে না।’
বরকতময় জীবিকা পাওয়ার আরেকটি অন্যতম সূত্র হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। হাদিসে এসেছে, ‘যার জীবিকার প্রসারতা ও জীবনের ব্যাপ্তি তাকে আনন্দিত করে, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (বোখারি)। আল্লাহ তায়ালার হেকমত ও অনুগ্রহের মধ্যে এটি একটি যে, তিনি দান-সদকা ও আল্লাহর পথে খরচ করার মধ্যেও অফুরন্ত জীবিকার ব্যবস্থা রেখেছেন। তাই যে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে তিনি তার বিপরীতে তাকে দান করেন এবং তার কাছে যা আছে তাতে বরকত দান করেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তোমরা যা কিছু ব্যয় করো, তিনি তার বিনিময় দেন। তিনি উত্তম রিজিকদাতা।’
(সূরা সাবা : ৩৯)। দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা এর পরিবর্তে কিছু দিয়ে এবং তাতে বরকত দিয়ে এর বিনিময় দান করেন। আর আখেরাতে উত্তম প্রতিদান ও বিশাল সওয়াবের মাধ্যমে বিনিময় দান করেন। কোরআনে এসেছে, ‘শয়তান তোমাদের অভাব-অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়।
পক্ষান্তরে আল্লাহ তোমাদের নিজের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও বেশি অনুগ্রহের ওয়াদা করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সুবিজ্ঞ।’ (সূরা বাকারা : ২৬৮)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘দুইটি বিষয় আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর দুইটি বিষয় শয়তানের পক্ষ থেকে। শয়তান অভাব-অনটনের ভয় দেখায়, আর বলে দান করো না, নিজের কাছে রেখে দাও।
ভবিষ্যতে তোমার প্রয়োজন হবে। আর অশ্লীলতার আদেশ দেয়। অন্যদিকে আল্লাহ তায়ালা গোনাহ ও পাপের জন্য ক্ষমার ওয়াদা করেন এবং রিজিকে অনুগ্রহের অঙ্গীকার করেন।’ তাই বেশি করে দান করা চাই। এতে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশাল ও ব্যাপক বিনিময়ের সুসংবাদ রয়েছে।