ঘুষের মাধ্যমে অন্যের প্রতি আর্থিক ও মানসিক যুলুম করা হয় বলে ঘুষখোররা যালেম হিসাবে অপরাধী। যুলুমের শাস্তি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের প্রতি যুলুম করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়।
তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ [শূরা ৪২/৪২]। আরো এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যালিমদেরকে পছন্দ করেন না’ [সূরা ৪২/৪০]। রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেন, اَلظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ. ‘যুলুম ক্বিয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে আচ্ছন্ন করবে’। [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১২৩ ‘যুলুম’ অনুচ্ছেদ।] হাদীছে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, يَا عِبَادِىْ! إِنِّىْ حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِيْ وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوْا. ‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার নিজের জন্য যুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের মধ্যেও সেটিকে হারাম গণ্য করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর যুলুম কর না’। [মুসলিম হা/২৫৭৭।]
২. ঘুষখোর হারাম ভক্ষণকারী হিসাবে শাস্তিযোগ্য: এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না’ [বাক্বারাহ ২/১৮৮]। রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেন, إِنَّ رِجَالاً يَتَخَوَّضُوْنَ فِىْ مَالِ اللهِ بِغَيْرِ حَقٍّ فَلَهُمُ النَّارُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ. ‘নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে আল্লাহর সম্পদ আত্মসাৎ করবে, ক্বিয়ামতের দিন তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম’। [বুখারী, মিশকাত হা/৩৯৯৫, ‘নেতৃত্ব ও বিচার-ফায়ছালা’ অধ্যায়, ‘কর্মচারীদের বেতন নেওয়া ও উপঢৌকন গ্রহণ করা’ অনুচ্ছেদ, হা/৩৭৪৬ ‘গনীমতের মাল বিতরণ ও তাতে খেয়ানত করা’ অনুচ্ছেদ।] তিনি আরো বলেন, لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّىَ بِاْلحَرَامِ. ‘হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। [শুআবুল ঈমান, মিশকাত হা/২৭৮৭, হাদীছ ছহীহ।]
৩. আমানতের খিয়ানতকারী : রাসূল [সা.] বলেন, مَنِ اسْتَعْمَلْنَاهُ عَلَى عَمَلٍ، فَرَزَقْنَاهُ رِزْقًا، فَمَا أَخَذَ بَعْدَ ذَالِكَ فَهُوَ غُلُوْلٌ. ‘আমি যাকে ভাতা দিয়ে কোন কাজের দায়িত্ব প্রদান করেছি, সে যদি ভাতা ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করে তাহ’লে তা হবে আমানতের খিয়ানত’। [৭. আবূদাউদ হা/২৯৪৩, মিশকাত/৩৭৪৮, হাদীছ ছহীহ।] আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমানতের খিয়ানতকারীদের পসন্দ করেন না’ [আনফাল ৮/৫৮]। আমানতের খিয়ানত মুনাফেকীর একটি অন্যতম আলামত’। [৮. বুখারী হা/৩৩ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘মুনাফিকের আলামত’ অনুচ্ছেদ।] আর মুনাফিকের শাস্তি জাহান্নাম। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। আর তুমি তাদের কোন সাহায্যকারী পাবে না’ [নিসা ৪/১৪৫]।
৪. ঘুষখোররা সূদের ন্যায় মারাত্মক গোনাহের অভিযোগে অভিযুক্ত ও দন্ডনীয় : রাসূল [সা.] বলেন, مَنْ شَفَعَ لِأَحَدٍ شَفَاعَةً، فَأَهْدَى لَهُ هَدِيَّةً عَلَيْهَا، فَقَبِلَهَا، فَقَدْ أَتَى بَابًا عَظِيْمًا مِنْ أَبْوَابِ الرِّبَا. ‘যে ব্যক্তি কারো জন্য কোন সুফারিশ করল এবং সেই সুফারিশের প্রতিদান স্বরূপ সে তাকে কিছু উপহার দিল ও সে তা গ্রহণ করল, তবে সে সূদের দরজাসমূহের একটি বড় দরজায় উপস্থিত হ’ল’। [আবূদাউদ, মিশকাত হা/৩৭৫৭, সনদ হাসান।] তিনি আরো বলেন, اَلرِّبَا سَبْعُوْنَ جُزْءًا، أَيْسَرُهَا أَنْ يَّنْكِحَ الرَّجُلُ أُمَّهُ. ‘সূদের ৭০টি গোনাহের স্তর রয়েছে। তার মধ্যে নিম্নতম স্তর হচ্ছে আপন মাতার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া’। [ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৮২৬, সনদ ছহীহ।] রাসূলুল্লাহ [সা.] আরো বলেন,دِرْهَمُ رِبًا يَأْكُلُهُ الرَّجُلُ وَهُوَ يَعْلَمُ، أَشَدُّ مِنْ سِتَّةٍ وَّثَلاَثِيْنَ زِنِيَّةً. ‘কোন ব্যক্তি যদি এক দিরহাম [রৌপ্যমুদ্রা] সূদ জ্ঞাতসারে গ্রহণ করে, তাতে তার পাপ ছত্রিশবার ব্যভিচার করার চেয়েও অনেক বেশী হয়’। [আহমাদ, মিশকাত হা/২৮২৫, সনদ ছহীহ।]
৫. ঘুষখোর যালিমরা নিরীহ মযলূমদের বদ দোআ ও প্রতিশোধের শিকার : রাসূল [সা.] বলেন, وَاتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُوْمِ، فَإِنَّهُ لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ. ‘তুমি মযলূমের বদ্দো‘আ থেকে বেঁচে থাক। কেননা মযলূমের বদদো‘আ ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা নেই’। [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৭৭২ ‘যাকাত’ অধ্যায়।] অর্থাৎ মযলূমের দো‘আ ব্যর্থ হয় না। তাছাড়া ক্বিয়ামতের দিন অন্যের সম্পদ ভক্ষণকারী যালিমের নিকট থেকে তার নেকী হ’তে মযলূমের বদলা পরিশোধ করা হবে। নেকী শেষ হয়ে গেলে মযলূমের পাপ যালিমের উপর চাঁপানো হবে। পরিশেষে তাকে নিঃস্ব অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১২৬।]
৬. ঘুষ লেনদেনকারীরা রাসূল [সা.] কর্তৃক অভিশপ্ত : রাসূলুল্লাহ [সা.] ঘুষ গ্রহীতা ও ঘুষ দাতার উপর লা‘নত বা অভিশাপ করেছেন’। [১৪. ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৩৭৫৩, হাদীছ ছহীহ।]
৭. ঘুষ ক্বিয়ামতের দিন বিপদের বোঝা হয়ে ঘুষখোরের কাঁধেই চেঁপে বসবে : রাসূলুল্লাহ [সা.] কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত জনৈক কর্মচারীর হাদিয়া গ্রহণের কথা শুনে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! ছাদাক্বার মাল হ’তে স্বল্প পরিমাণও যে আত্মসাৎ করবে, সে তা কাঁধে নিয়ে ক্বিয়ামত দিবসে উপস্থিত হবে। সেটা উট হ’লে তার আওয়ায করবে, গাভী হ’লে হাম্বা হাম্বা শব্দ করবে এবং বকরী হ’লে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকবে’। [বুখারী হা/২৫৯৭।]
৮. ঘুষখোররা ইবাদত ও দান-খয়রাত করেও ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত : রাসূলুল্লাহ [সা.] দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, ধুলা মলিন এলোকেশে ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, সে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করছে,يَا رَبِّ! يَا رَبِّ! وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشَربُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِىَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ.‘হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম। আর তার দেহও হারাম উপার্জন দ্বারা গঠিত। তার প্রার্থনা কবুল হবে কিভাবে’? [ মুসলিম, মিশকাত হা/২৭৬০।] অর্থাৎ হারাম ভক্ষণ করায় তার প্রার্থনা কবুল হবে না যদিও মুসাফিরের প্রার্থনা সাধারণত কবুল হয়ে থাকে। [ আবূদাঊদ হা/১৫৩৬, তিরমিযী হা/১৯০৫, হাদীছ হাসান।]