এবার বাড়ীতে যেয়ে – বৃদ্ধ মানুষের পায়ের নখ খুব শক্ত থাকে। কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর নরম হলে নখ কাটতে সুবিধা হয়। তাতে বড় নখের কারণে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কদিন যাবত এ কথাটা বারবার মনে পড়ছিল।
মনে পড়ছিল আমার বাবার পায়ের নখের কথা। বারবার ভাবছিলাম এবার বাড়ীতে যেয়ে নিজ হাতে বাবার পায়ের নখগুলো কেটে দিব। তাহলে বাবা নামাজ পড়তে যাবার জন্য হাঁটার সময় বড় নখের জন্য আর হোঁচট খাবেন না। বাবার নখ কাটার পরিকল্পনাটা ছোট মেয়েকে শেয়ার করলাম। সে বললো আমিও দাদুর নরম সারা শরীর ধরবো, দাড়িতে হাত বুলিয়ে দিব। শুনে খুব খুশি হলাম যে আমার শরীরে থাকা বাবার জীন আমার সন্তানকেও প্রভাবিত করেছে।
আমার মা আমার বাবার প্রতি অসম্ভব কেয়ারিং। আর বাবা মায়ের প্রতি ভীষণ নির্ভরশীল। ভদ্রলোকের জীবনে একটা টাকার প্রয়োজন হলেও মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন। অর্থাৎ মা নির্ভর পরিবার যাকে বলে। কিন্তু মায়েরও বয়স হয়েছে দেখে ভাবলাম এবার বাবার নখ কাটার কাজটা নিজে করবো। সাথে প্রিয় বাবাকে অনেকদিন না দেখার সাধ পূরণ হবে। আমার সুদর্শন আর সুপুরুষ বাবার শরীরের পছন্দের গন্ধটা যে অনেকদিন পাইনা!
অনেকদিন ছুটি পাইনা। তাছাড়া বিভিন্ন পর্বনে কাজের চাপ বেশি থাকে। তাই ছুটিও হয়না। সেজন্য ভাবলাম এবার রোজার ঈদের পর ছুটি যাব। তখন ঝামেলা কম থাকে। ছুটিতে কদিন বাবার কাছে একটু বসবো।
পরিকল্পনা মোতাবেক ঈদের পর ছুটি যাব বলে ঈদের পূর্বে আবেদন করলাম। ডিসি গুলশান মোস্তাক স্যার ছুটির বিষয়ে ভীষণ উদার। তিনি ছুটি দিলেন ঠিকই তবে তা ঈদের আগেরদিন থেকে তিনদিন। বললেন,যাবেন যখন বাড়িতে ঈদটা করে আসেন। বাড়িতে ঈদ করার প্রস্তুতি না থাকলেও স্যারের কথায় কৃতজ্ঞ হলাম। স্ত্রী পরিজনও মহাখুশি।
শেষ রোজার সেহেরি খেয়ে রওনা দিলাম খুলনার উদ্দেশ্যে। বাবা মাকে দেখার আনন্দে মন উদ্বেলিত হলেও বাচ্চাদের সামনে লজ্জায় তা প্রকাশ করতে পারছিনা। বারবার রাস্তার মাইলফলক দেখছি। মনে মনে ভাবছি বাড়ীতে পৌঁছেই বাবা মা আর সবার জন্য কেনা কাপড়-চোপড়সহ অন্যান্য জিনিস বের করে মায়ের হাতে দেব। সবাই খুশি হবে, আর তাতেই আমার আনন্দ। তারপর মিশন বাবার পাশে বসে গল্প করা, বাবাকে তাঁর প্রিয় মিষ্টি খাওয়ানো, বাবার নখ কাটা ইত্যাদি।
এভাবে ভাবতে ভাবতে বাগেরহাটে জুম্মার নামাজ পড়ে আবার খুলনার পথে। সামান্য অপেক্ষার পালা। মনে মনে ভাবছি সবাই অপেক্ষা করছে রাস্তায় আমাদের রিসিভ করতে। আহারে! কতদিন পর বাবা মাকে দেখবো!
আর মাত্র ১০ মিনিটের পথ। বাচ্চারা খুব উৎফুল্ল আর উত্তেজিত! মনে মনে আমিও বাবা মায়ের জন্য….। এমন সময় থানা থেকে অপস অফিসারের ফোন। কলটা দেখে শরীরে একটা মোচড় মারলো। আমি তিনদিনের ছুটিতে। খুব জরুরি না হলে থানা থেকে ফোন করার কথা না। অজানা আতঙ্ক নিয়েই ফোন ধরলাম। “স্যার, ঘটনা খারাপ, জুম্মার নামাজ থেকে বের হবার পর উত্তর বাড্ডায় সন্ত্রাসীরা একজনকে গুলি করেছে, মারা গেছে”। শুনে মনে হল গুলিটা আমাকে করলেই ভাল হত। ফোনে আমার কথা শুনে স্ত্রী সন্তানদের বুঝতে আর বাকি থাকলো না।
মুহুর্তেই সবার মুখগুলো ছোট হয়ে আসলো। আমি জানি থানায় ফেরত গেলেও খুব বেশি কিছু করতে পারবোনা। তবু আমি গেলে অভিভাবক হিসেবে সবাই একটু সাহস পাবে। তাই ওখান থেকেই থানায় ফেরত আসার সিদ্ধান্ত নিতে হল। স্ত্রী সন্তানদের কোনরকম বাড়িতে পৌঁছতেই দূর থেকে দেখলাম আমার বাবা মাসহ সবাই রাস্তায় অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন পর ছেলে নাতিরা এসেছে খুশি আর ধরে কই ? কে কি দিবে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি। কিন্তু আমাদের নীরবতা দেখে মুহুর্তেই সবার মুখ মলিন হয়ে গেল। সাবেক পুলিশ অফিসার হিসেবে আমার বাবা খুব দ্রুতই সব বুঝে গেলেন।
সবাইকে রেখে সাথে সাথেই ঢাকার পথে রওনা। মায়ের চোখে পানি। আমার এভাবে ১০ মিনিটেই ফেরত যাওয়া মেনে নিতে পারছেনা কেউই। আমার বাবার পায়ের দিকে আর লক্ষ্য করার সময় কই ? এমনিতেই আমি বাবা মাকে আসার সময় কখনো কদমবুছি করিনা। কারন আমার খুব ভয় হয়, মনে হয় কদমবুছি মানে বিদায় নেয়া। যদি সত্যিই পরেরবার এসে বাবা-মাকে না দেখতে পাই? সে ভয়েই আমি কদমবুছি থেকে বিরত থাকি। তাই আর বাবার পা টাও দেখতে পারলাম না, নখ কাটা তো দুরের কথা!
ঘাটে আসতে আসতে সন্ধ্যা। স্পিডবোর্ডে উঠতেই ইফতারির সময় হল। শুধুমাত্র পানি দিয়ে ইফতার। মাওয়া ঘাটে পৌঁছানোর পূর্বেই প্রচণ্ড ঢেউ আর স্রোতে ভিজে একাকার। স্পিডবোর্ড উল্টে যাওয়া থেকে কোনরকম রক্ষা পেয়ে কাক ভেজা অবস্থায় জীবন নিয়ে ঘাটে ভিড়তেই ঠেলাঠেলি। নামার আগেই নতুন যাত্রী উঠাতে পড়ি কি মরি অবস্থা। টের পেলাম পদযুগল জোড়া বিহীন হয়েছে। রোজা থেকে সারাদিন দুবারের জার্নির ধকল আর ভেজা শরীর নিয়ে কোনরকম ঘাটে উঠেই ব্যাগ খুলে দেখি তোয়ালে ছাড়া আর কিছুই নেই। অর্থাৎ বাড়ীতে ব্যাগ খুলে সবকিছু বের করার সময় ভুলে নিজের কাপড়ও… । এদিকে প্রচণ্ড ক্ষুধা। অগত্যা কেউ আমাকে চেনে কিনা এদিক ওদিক কিছুক্ষণ দেখে খালি গায়েই খেতে বসলাম হোটেলে।
থানায় পৌঁছেই গেলাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে। কথা বললাম নিহতদের আত্মীয় স্বজনের সাথে। পরদিন সকালেই ঈদ, বের হলাম ঈদ জামাতের ডিউটিতে। পরিবার ছাড়া সহকর্মীদের নিয়েই কাটালাম। একসময় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসলো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলো। সব মানুষের জীবন যাত্রা স্বাভাবিক হল।
এরমধ্যে বাবা আমার অনেকবার ফোন করেছেন। কান্না জড়িত কন্ঠে কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লেগেছে। বারবার মনে পড়েছে আমার বাবার পায়ের নখের কথা। যদি সত্যি কখনো আমার বাবা নখে আঘাত পান তবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না কোনদিনই। প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার বাবার সামান্য সেবাটুকু করতে পারলাম না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হওয়ায় আর চাকরি নামক গুরু দায়িত্বের কারণে বাবা মায়ের ন্যূনতম সেবা করাও আমাদের জন্য আজ সুদূর প্রসারী। পরিবার নিয়ে কখনো সুখানন্দ তো দূরের কথা! তবুও ভাল থাকুক সবাই।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যাত্রাবাড়ি থানা, ডিএমপি। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)