পিঠে ব্যাথা আর জ্বরে ভুগছিলেন ৫৬ বছর বয়সি এক প্রৌঢ়া। চিকিত্সার জন্য হাসপাতালে যেতেই ডাক্তারদের চক্ষু চড়কগাছ। পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর দেখা যায়, ওই প্রৌঢ়ার ডানদিকের কিডনিটি পাথরে ভর্তি। প্রায় ৩,০০০টি পাথর মিলেছে সেই কিডনি থেকে।
ঘটনাটি ঘটেছে চীনের জিয়াংশু প্রদেশের চাংঝাউয়ের উজিন হাসপাতালে।
চীনের গ্লোবাল টাইমসের খবরে প্রকাশ, গত এক সপ্তাহ ধরে পিঠে ব্যাথা শুরু হয়েছিল ঝাং-এর। মেডিক্যাল পরীক্ষার পর ডাক্তাররা আবিষ্কার করেন, ঝাং-এর একটি কিডনি পাথরে ভরে গেছে। অপারেশনের পর সেই পাথর গুনতে সময় লেগেছে প্রায় এক ঘণ্টা। মোট ২,৯৮০টি পাথর ঝাং-এর শরীর থেকে বের করা হয়েছে।
গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের রিপোর্ট বলছে, কিডনি থেকে সবচেয়ে বেশি পাথর উদ্ধারের ঘটনার নজির রয়েছে ভারতে। মহারাষ্ট্রের এক রোগী ধনরাজ ওয়াডিলের কিডনি থেকে ১,৭২,১৫৫টি পাথর বেরিয়েছিল।
বাংলাদেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি ঘণ্টায় মৃত্যুবরণ করছে পাঁচজন।
আজ রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের ফ্রি কিডনী পরীক্ষা ও কিডনী সচেতনতা মূলক সেমিনারে ল্যাব এইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের কিডনি বিভাগের চিফ কনসালটেন্ট ও ক্যাম্পস-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে একথা বলেন।
কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) এই ফ্রি এর বিবিধ সেবা কার্যক্রমের বিশেষ অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাথে যৌথ উদ্যোগে এই ফ্রি কিডনি স্ক্রিনিং ও কিডনি রোগ সম্পর্কে সচেতনতামূলক সেমিনারের আয়োজন করে।
ক্র্যাব সভাপতি আবু সালেহ আকনের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) এর সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, সাধারণ সম্পাদক মুরসালিন নোমানী, ক্র্যাব সাধারণ সম্পাদক সরোওয়ার আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। দিন ব্যাপী চলমান ফ্রি স্ক্রিনিং কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় ২০০ জন পেশাদার সাংবাদিকের স্ক্রিনিং করা হয়।
অধ্যাপক এম এ সামাদ বলেন, সাধারণত ৭৫ ভাগ কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে রোগীরা বুঝতেই পারে না যে, সে ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিডনি রোগের চিকিৎসা এতোই ব্যয়বহুল যে, এদেশের শতকরা ১০ ভাগ লোকেরও সাধ্য নেই এই ব্যয় বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাবার। সচেতন হলে শতকরা ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে ভয়াবহ কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, দেশে অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৬৩ ভাগ লোকের মৃত্যু হয়, আগামী ১০ বছরে এ হার ৭০ ভাগ ছাড়িয়ে যাবে, কারণ প্রতিবছর দুই ভাগ হাড়ে বৃদ্ধি পায়। সচেতন হলেই এবং লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমান বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে একজন কিডনি রোগী।
কিডনি রোগ প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক ভাবে ১০টি স্বর্ণালী সোপান কঠিনভাবে অবলম্বনের তাগিদ তৈরি হয়েছে জানিয়ে এম এ সামাদ বলেন, কায়িক পরিশ্রম ও খেলাধূলা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা, ধূমপান থেকে বিরত থাকা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ যাতে প্রতিদিন শাকসবজি ও ফল থাকবে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা ও ফাস্টফুড পরিহার করা, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, পরিচ্ছন্ন থাকা ও খাবার পূর্বে হাত ধোয়া, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ব্যাথা নাশক ও এন্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন না করা, নিয়মিত কিডনির কার্যকারীতা পরীক্ষা করা।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ব ব্যাপি আজ কিডনি রোগের ভয়াবহতা সংশ্লিষ্ট সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন। তারা মনে করেন যে, চিকিৎসা করে নয় বরং প্রতিরোধ করেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব প্রশমন করতে হবে। আর এ জন্য সচেতনতাই একমাত্র উপায়।
কিডনি সমস্যার সুরাহা খুঁজতে এবার ডায়ালিসিস বা প্রতিস্থাথাপনের দিন শেষ হলো। বিকল অঙ্গের বদলে ব্যবহার হতে চলেছে কৃত্রিম কিডনি, যার খরচও তুলনায় কম।
কিডনি বিকল হলে রক্ত শোধনে ঘাটতি দেখা দেয়। শরীরে বিষাক্ত বর্জ্য জমে রক্ত-দূষণ সৃষ্টি করে। বর্তমানে এই সমস্যা সমাধানের জন্য ডায়ালিসিস প্রক্রিয়ার সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে রক্ত শোধন করা হয়ে থাকে, যার জন্য রোগীকে একাধিক দিন হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। শুধু তাই নয়, ডায়ালিসিস চলাকালীন বা পরে অধিকাংশ রোগী ডায়াবিটিস ও হাইপারটেনশনে ভোগেন, যা সমস্যা আরও জটিল করে তোলে। বিকল কিডনির বদলে রোগীর দেহে সুস্থ কিডনি প্রতিস্থাপনও হয়ে থাকে, তবে তা সহজলভ্য নয় এবং খরচ সাপেক্ষ। এই সমস্ত সমস্যার সমাধানে আগামী দশকের মধ্যেই বাজারে আসছে কৃত্রিম কিডনি, যা স্বাভাবিক কিডনির সব কাজ করতে সক্ষম।
গত বুধবার ট্যাঙ্কার বার্ষিক চ্যারিটি অ্যান্ড অ্যাওয়ার্ডস নাইটে কৃত্রিম কিডনির কথা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং যন্ত্রের সহ-আবিষ্কারক ডক্টর শুভ রায়। তিনি জানিয়েছেন, হাতের মুঠোর আকারের কৃত্রিম কিডনি চলতি দশকের শেষ অথবা নয়া দশকের গোড়ায় বাজারে পাওয়া যাবে। আমেরিকায় তৈরি এই যন্ত্র আপাতত সে দেশের কয়েক হাজার রোগীর দেহে পরীক্ষামূলক বসানো হয়েছে। শারীরিক সুরক্ষা এবং সর্বাঙ্গীন সাফল্যের পরীক্ষায় উতরোলে তা বাজারে ছাড়ার অনুমতি দেবে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক এফডিএ।
ডক্টর রায় জানিয়েছেন, যন্ত্রটি সহজেই পেটের ভিতরে স্থাপন করা যায় এবং স্বাভাবিক কিডনির মতো রক্ত শোধন করা ছাড়াও তা হরমোন উত্পাদন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। সাধারণ হিমোডায়ালিসিস প্রক্রিয়ার মতো রক্ত থেকে বিষাক্ত বর্জ্য বাদ দেওয়া ছাড়াও জীবন্ত কিডনি কোষ দিয়ে তৈরি বায়ো রিঅ্যাক্টর এবং সূক্ষ্ম পর্দার মাধ্যমে রক্ত শোধনের কাজ নিখুঁত ভাবে করতে পারে কৃত্রিম কিডনি।
ডক্টর রায়ের দাবি, ডায়ালিসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপনের চেয়ে অনেক কম খরচে বসানো যাবে কৃত্রিম কিডনি।