রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ষাট ফুট খালটি সচল করা জরুরী

রাজধানীর জলাবদ্ধতা- রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন ও অসহনীয় জনদূর্ভোগ দূরীকরনে ষাট ফুট খালসহ সরকারী বেদখলকৃত খালগুলি উদ্ধার করে পুনরায় সংস্কারের কোন বিকল্প নেই।

সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার শিকার বাউনিয়া খাল-সংলগ্ন বৃহত্তর মিরপুরের ২০ লক্ষাধিক মানুষের দুঃখ-দূর্দশার শেষ নেই। খাল উপচানো পানিতে পুরো এলাকা সয়লাব হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে চরম দুর্গন্ধযুক্ত দুষিত ময়লা পানির স্রোত অলিগলি এমনকি প্রধান সড়কেও গড়াগড়ি করে। দুষিত বিভিন্ন ময়লা মিশ্রিত পানি ঢুকে পড়ে বাসাবাড়ির ভিতরেও।

একবার পানি ঢুকলেই তিন-চার দিনের আগে সে জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় না থাকায় বসতবাড়ির দামী আসবাব পত্র বিনষ্ট সহ নানা রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। জবরদখলে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া যাওয়া বাউনিয়া খালটি এখন বৃহত্তর মিরপুরবাসীর জন্য স্থায়ী অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মিরপুর-১৪ থেকে গোড়ান চটবাড়ী পর্যন্ত ১০-১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালের প্রস্থ ৬০ ফুট। পুরনো এয়ারপোর্ট, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, ভাসানটেক ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সমুদয় পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথ বাউনিয়া খালে সারা বছরই স্বচ্ছ পানির স্রোত বয়ে বেড়াত। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের চলমান ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের জয়নগর প্রকল্পের নামে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে বাউনিয়া খালের অস্তিত্ব। খালের সিংহভাগ অংশ জবরদখল করে এসব প্রকল্পের বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন গড়ে তোলার উদ্যোগেই পানিপ্রবাহের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

৬০ ফুট প্রশস্তের খালটির অনেক জায়গায় এখন ৫-১০ ফুট নালার অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা আর মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একের পর এক চিঠি চালাচালি, যৌথ সভা, সীমানা নির্ধারণ— কোনো কিছুতেই কিছু হয়নি, মুক্ত হয়নি খাল।

এইডস খাল দ্রুত দখলমুক্ত না হলে বর্ষায় তলিয়ে যাবে এসব এলাকা। শুধু বর্ষা নয়, শুষ্ক মৌসুমেও তৈরি হবে স্থায়ী জলাবদ্ধতা।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলবাজির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যক্তিপর্যায়েও বাউনিয়া খাল দখলের রীতিমতো উৎসব শুরু হয়ে গেছে। খালের ওপর বাঁশ, টিন দিয়ে শত শত ঘরের বাগানবাড়ী বস্তি পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে। বস্তি বানাতে খালজুড়ে কয়েক হাজার বাঁশের খুঁটি পুঁতে বাঁধের মতো করে পানিপ্রবাহ আটকে দেওয়া হয়েছে। খালের মধ্যে বিপুল পরিমানে প্লাস্টিক বোতল, টিন, পলিথিনসহ বিভিন্ন বর্জ্য জমে আছে। খালে পানি প্রবাহিত হতে না পারায় বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনা জমে জমে স্তূপের সৃষ্টি হয়েছে। এ ময়লা-আবর্জনা এবং অপরিচ্ছন্ন পানির কারণে মশার প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে পড়েছে খালটি। বাউনিয়া খালের বিভিন্ন পয়েন্টে জবরদখলের দৌরাত্ম্য ও দখলবাজির কৌশলগুলোও প্রায় অভিন্ন। শুরুতে স্রোতোবাহী খালের পানিতে খুঁটি পুঁতে অস্থায়ী মাচানঘর বানানো হয়। এরপর ময়লা-আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট ফেলে ভরাট করা হয় খাল। ছোট ছোট বাঁধ দেওয়ার নজিরও রয়েছে। একপর্যায়ে প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে গড়ে তোলে স্থায়ী পাকা স্থাপনা।

এর আগে ঢাকা উত্তর সিটির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক খাল দখলের বেহাল পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছিলেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানের বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘যেখানেই গেছি, সেখানেই দেখতে পেয়েছি কেবল জবরদখলের মহোৎসব। প্রভাবশালীরা খালগুলো দখল করে ফেলেছে। খালের ওপর মসজিদ, স্কুল, মাঠ ইত্যাদি হয়ে গেছে। ’প্রয়াত মেয়র বলেছিলেন, ‘ঢাকার জলাবদ্ধতা দেখার জন্য আমি ২৯টি ওয়ার্ডে গিয়েছি। দেখেছি কোথাও খাল আর খাল নেই। মিরপুর-১৪ নম্বর থেকে যে বাউনিয়া খালের উৎপত্তি, এটা ওজিএসডি হাসপাতাল থেকে বাইশটেকি গেছে। ৬০ ফুটের খালটি বাউনিয়া পর্যন্ত গিয়ে ২০ ফুট হয়ে গেছে। পলাশনগর কালশী গিয়ে ওই খালের আর অস্তিত্বই নেই। ’ তিনি বলেছিলেন, মিরপুর কলেজের কাছ থেকে আরেকটি খাল দুয়ারীপাড়ায় গিয়েই শেষ হয়ে গেছে। একটি হাউজিং কোম্পানি খালটি ভরাট করে মাঠ বানিয়েছে। রাজউক তাদের খাল রাখার শর্তে অনুমতি দিলেও তারা পাইপ বসিয়ে পানির পথ তৈরি করে দিয়েছে। এই পাইপ দিয়ে এত পানি যাবে কীভাবে! কুড়িল, নর্দা, নিকুঞ্জ এলাকায়ও খালের অস্তিত্ব নেই। বাউনিয়া খাল দখলের ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে বৃহত্তর মিরপুরে। এখন ১০-১২ মিনিটের বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট ডুবে যায়। বাড়িঘরের নিচতলাতেও পানি ঢুকে পড়ে। ময়লা-আবর্জনার মাখামাখিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে উৎকট গন্ধ। সে পানিতে পা ফেলতেও ঘৃণায় গা রি রি করে ওঠে। অথচ হাজার হাজার নারী-পুরুষ কোথাও হাঁটু পরিমাণ, কোথাও বুকসমান পানিতে গা ডুবিয়ে তবেই নিজ গৃহে পৌঁছাতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন,

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ষাট ফুট খালটি সচল করা জরুরীরাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ষাট ফুট খালটি সচল করা জরুরী

বাউনিয়া খালটির পানিপ্রবাহ ঠিক থাকলে বৃহত্তর মিরপুরে জলাবদ্ধতার সমস্যা থাকবে না বললেই চলে। কিছু লোক অবৈধভাবে খালে অবৈধ স্থাপনা তুলেছে, তুলছে। সরকারিভাবে নির্মিত হচ্ছে সারি সারি বহুতল ভবন। ওয়াসার সহায়তায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে খালের সংস্কার করতে গেলে দখলবাজরাই উল্টো ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। সন্ত্রাসী-মাস্তান লেলিয়ে হুমকি-ধমকিও দিয়েছে। জামাল মোস্তফা বলেন, বৃহত্তর মিরপুরের অন্তত ২০ লাখ বাসিন্দা বাউনিয়া খাল দখলের অভিশাপে বেহাল জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। খালটি উদ্ধার করে দুই পারে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে দিলে তা অবসর কাটানোরও সেরা জায়গায় পরিণত হবে। এ ব্যাপারে প্যানেল মেয়র প্রধামন্ত্রীর সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এদিকে সিএস রেকর্ড অনুযায়ী খালগুলো পুনরুদ্ধারসহ সংস্কারের কাজে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়ার অনুরোধ এসেছে। অতিসম্প্রতি নগর ভবনে সরকারের আন্তবিভাগীয় সমন্বয় সভায় পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও জনপ্রতিনিধিরা সেনাবাহিনীকে খাল উদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রভাবশালীরা এসব খাল দখল করে বড় বড় ভবন, মার্কেট, দোকানপাট ও রাস্তা নির্মাণ করেছে। তারা জলাভূমিও ভরাট করেছে। ধীরে ধীরে ঢাকার চারপাশের চারটি নদীও জবরদখল হয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টি হলেই ঢাকা শহর পানিতে ডুবে যায়। তারা সেনাবাহিনীর সাহসিকতা ও সফলতা বোঝাতে গিয়ে ‘হাতির ঝিল প্রকল্পের’ সফলতাকে সামনে নিয়ে আসেন। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এ প্রকল্পটি সফল হয়েছে। সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিলে সব খাল উদ্ধার সম্ভব হবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল।