রেললাইনের পাশে বস্তিতে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস

রাজধানী ঢাকায় রেললাইনের দুই পাশে বসবাসকারী বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের বিষয়ে স্থায়ী কোনো সমাধান কখনোই হয়নি। যদিও কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি সেই উদ্যোগ। ফলে রেল লাইনের পাশে প্রতিনিয়ত মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন বস্তিবাসী।

কয়েকবছর আগেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন রেল লাইনের পাশের বস্তি উচ্ছেদ করেছিল। বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ করা হলেও আবার গড়ে উঠেছে নতুন বস্তি। আর্থিক বাণিজ্যের কারণে মূলত স্থায়ীভাবে বস্তি উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না বলে অভিমত নগর বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, এই ভাবে বসবাস খুবই বিপজ্জনক। রাষ্ট্রের উচিত, এই মানুষগুলোকে আবাসনের ব্যবস্থা করে অন্য কোথাও দ্রুত সরিয়ে নেওয়া।

বছরের পর বছর নিম্নআয়ের মানুষ অস্বাস্থ্যকর, ঝুঁকিপূর্ণ ও নাগরিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত অবস্থায় বস্তিতে বসবাস করছেন, তারা এখন নগরজীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছেন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকার কারণে এই বস্তিবাসীদের সন্তানরা অনেকেই খুব অল্প বয়সেই নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তবে আশার দিক হচ্ছে, বস্তিবাসী লোকজনকে অবহেলার চোখে দেখলেও বস্তির শ্রমজীবী মানুষ ঢাকার পোশাক শিল্প, পরিবহন শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসাসহ নানা কাজের চাকা সচল রেখেছে।

জানা গেছে, মহাখালী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রেল লাইনের দুই পাশে গড়ে ওঠা বস্তিতে অন্তত দশ-বারো হাজারের বেশি পরিবারের বসবাস। এই বস্তিতে বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেটের সুব্যবস্থা নেই। সেখানে বিদ্যুতের সংযোগও নেই, তবে যদিও অনেকে অবৈধ সংযোগ নিয়েছেন। বসবাসের জন্য ঘিঞ্জি পরিবেশ, অপ্রতুল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও অধিক ভাড়ার পাশাপাশি নানা দুরবস্থার মধ্যে বাস করে বস্তিবাসীরা। নানা সমস্যার পাশাপাশি উচ্ছেদ আতংকও কাজ করে। সবমিলিয়ে কঠিন জীবন পার করছেন তারা। জানা গেছে, রেলওয়ের জমিতে ছাপড়াঘর তুলে ভাড়া দেয় এলাকার প্রভাবশালীরা। এভাবে যেখানে সেখানে গড়ে ওঠে অপরিকল্পিত বস্তি। বিদ্যুত্, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, শিক্ষা আর নিরাপত্তাসহ নাগরিক সব সুবিধাবঞ্চিত এই ঘিঞ্জি পরিবেশেই কোনোমতে দিন পার করেন বাসিন্দারা।

কাওরানবাজার রেললাইনের পাশের বস্তিতে বাস করেন আবুল মিয়া। ঠাকুরগাঁওয়ের এ অধিবাসী স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ছোট্ট একটি রুমেই গাদাগাদি করে বাস করেন। পেশায় ভ্যান চালক আবুল জানান, এক রুমের মাসিক ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার টাকা। তারপরও নেই গ্যাস, পানি ও নিরাপদ বিদ্যুত্ সরবরাহের ব্যবস্থা। তিনি বলেন, কোনো উপায় না থাকায় রেল লাইনের ধারে ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করি। একই বস্তির বাসিন্দা নেত্রকোনার সবুজ মিয়া জানান, ৮ বর্গফুটের জায়গার ওপরে ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে নিজেই ছাপড়াঘর তুলেছেন। পাশের কয়েকটি ঘর দেখিয়ে বলেন, ৮ বর্গফুটের একটি ঘরের ভাড়া তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। তার স্ত্রী আকলিমা বেগম বলেন, পেটের দায়ে থাকি। এখানে স্বামী ভ্যানে সবজি বিক্রি করে, আমি মেসে রান্নার কাজ করি। এটা দিয়ে সংসার চালাই। বস্তির বাসিন্দারা জানান, কাওরানবাজার রেললাইনের এই বস্তিতে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষের বসবাস। এর জন্য পানির কল আছে মাত্র ৫টি। গোসলখানাও ৫টি। এখানে ৫ টাকার বিনিময়ে এক কলস পানি কিনে গোসল করতে হয়। পুরো বস্তির জন্য টয়লেট রয়েছে ৪টি। সেখানে ৩ টাকার বিনিময়ে সিরিয়ালে প্রয়োজন মেটাতে হয়। এখানে নেই কোনো গ্যাস ও বিদ্যুত্ সংযোগ।

সরকারি হিসাবে, ঢাকায় বস্তির সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি। এছাড়া ঢাকায় মোট বসবাসকারী মানুষের ৩৫ শতাংশই থাকে বস্তিতে। আইসিডিডিআরবি’র হিসাবে, ১৯৯১ সালে ঢাকায় বস্তি ছিল দুই হাজার ১৫৬টি, পাঁচ বছর পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭টিতে। আর ২০০৫ সালে তা ৪ হাজার ৯৬৬টিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দশ বছরে এই সংখ্যা কত বেড়েছে সেই পরিসংখ্যান এখন পাওয়া না গেলেও সংখ্যা যে ৫ হাজার ছাড়িয়েছে তাতে কারও সন্দেহ নেই।