রাজধানীর কড়াইল বস্তি ঘিরে বছরের পর বছর ধরেই চলছে হরেক রকম দখলবাজি। কেউ বস্তির আধিপত্য দখল নিয়ে লড়াই করছে কেউবা বস্তি ভেঙে গড়ে তুলছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ক্ষমতার বাহাদুরিতে কেউ কেউ এগিয়ে গেছে আরও কয়েক ধাপ। তারা বস্তি সংলগ্ন লেকের পানিতে ময়লা-আবর্জনা আর মাটি ভরাট করে বস্তি সাম্রাজ্যের আরও বিস্তার ঘটিয়ে চলছে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে লেক ভরাটের মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে বস্তির আয়তন। ঝুপড়ি বস্তির কাঁচা ঘরগুলো এখন রাতারাতি পাকা বিল্ডিংয়ে পরিণত হচ্ছে।
এখানে চলছে সরকারি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অবৈধ সংযোগ। চুরি-ছিনতাই তো নিয়মিত ঘটনা। সরকারি জায়গা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিকে পুঁজি করেই কড়াইল বস্তিতে অন্তত ৩৬ জন কোটিপতি বনে গেছেন। বর্তমানে নয় সদস্যের আরেক সিন্ডিকেট শত কোটি টাকার নয়া ধান্ধা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। সরেজমিন দেখা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ বস্তির বেলতলা অংশ পুরোপুরি দখলের পর এখন বিটিসিএলের ফাঁকা জায়গাও জবরদখল শুরু করেছে। ওই জায়গায় বাঁশ ও খুঁটির সাহায্যে নতুন নতুন ঘর তোলার কাজ চলছে। এদিকে দখলবাজ গ্রুপের আরেক নেতা ও তার সহযোগীরা লেকের পানিতে বাঁশ পুঁতে, বাঁশের মাচান বানিয়ে একের পর এক ঘর তুলছেন।
আগাম জামানত দিয়ে সেসব ঘর ভাড়া নিচ্ছেন লোকজন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক মুদি দোকানদার জানিয়েছেন, এভাবে জবরদখল করে গত ছয় মাসেই কড়াইল বস্তিতে তিন শতাধিক নতুন ঘর নির্মাণ হয়েছে। এদিকে আরেকটি প্রভাবশালী গ্রুপের নেতৃত্বে কড়াইল বস্তির পূর্বাংশ জুড়ে চলছে দোতলা বাড়ি নির্মাণের কাজ। ঝুপড়ি-বস্তির ঘরগুলো পাকা বিল্ডিং করলেই আর উচ্ছেদের ধকল পোহাতে হবে না— এমন প্রচার প্রচারণা চালিয়ে বস্তির লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ফলে অভাবী বস্তিবাসীও ধারদেনা করে, বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পাকা ঘর বানানোর কাজে মেতে উঠেছে। বস্তির বাঁশের বেড়ার টিনের ঘরকে পাকা বিল্ডিং বানাতে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। ঘরপ্রতি বনানী থানার নামে এক লাখ টাকা পেমেন্ট দেখিয়ে বাকি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা।
গত দুই মাসে কড়াইল বস্তিতে চাঁদা শোধের ভিত্তিতে অর্ধশতাধিক পাকা বিল্ডিং নির্মিত হয়েছে, কাজ চলছে আরও অর্ধশতাধিক ভবন নির্মাণের। তবে চাঁদার টাকা পরিশোধ ছাড়া কেউ ঘরের মেঝেটুকু পাকা করারও সুযোগ পান না। জানা গেছে, গুলশান গাউসুল আজম মসজিদের উত্তর-পশ্চিম পাশের লেক ভরাট করে প্রায় ৩ শতাধিক ঘর নির্মাণ করে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ ও পানি নিয়ে ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছেন কয়েকজন। রাজধানীর গুলশান-বনানী লেক ভরাট করে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি নিয়ে বস্তি ঘর ভাড়া দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, গুলশান-বনানীর গা-ঘেঁষে ১৯৫৬ সালে তৎকালীন টিঅ্যান্ডটির নামে সরকার ১৭০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ১০ একর জায়গা বিটিসিএলের দখলে থাকলেও বাদ-বাকি ১৬০ একরের পুরোটাই বেদখল। এখানে অবৈধভাবে দিনে-দিনে বেড়ে ওঠে কড়াইল বস্তি। এই বিশাল বস্তিতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের বসবাস।
জায়গা দখল, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি চুরি : জানা গেছে, ১০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি বছরের পর বছর ধরে কড়াইল বস্তি সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। দখলদাররা গড়ে তুলেছেন কল্যাণ সমিতি। রাজনীতির ছায়ায় বস্তির প্রভাবশালী কোটিপতির সংখ্যাও কম নয়। বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বস্তিতে ঘর তুলে জায়গা দখল করে কোটিপতি বনে গেছেন এমন মানুষের সংখ্যা পনেরো জনের বেশি। বস্তিতে চোরাই গ্যাস সরবরাহ করে কোটিপতি বনেছেন ৬ জন, চোরাই বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে আরও ১১ জন কোটিপতি হয়েছেন। ওয়াসার লাইন থেকে পানি সরবরাহ দিয়েও কয়েকজন কোটিপতির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, কড়াইল বস্তির সোয়া তিন লাখ বাসিন্দাকে জিম্মি করে ৯ সদস্যের সিন্ডিকেট মাসে চার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, বস্তিবাসীর কাছ থেকে মাসে বিদ্যুতের বিল বাবদ নেওয়া হয় এক কোটি ৯২ লাখ টাকা। প্রতিটি গ্যাসের চুলার জন্য দিতে হয় ৬০০ টাকা করে। বস্তিতে ১২ হাজার চুলা ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব চুলা থেকে প্রতি মাসে উঠছে ৭২ লাখ টাকা। পানির জন্য নেওয়া হয় মাসে এক কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে মাসে উঠছে আট কোটি টাকার মতো। ইতিমধ্যে এ চাঁদার টাকায় ইলেকট্রিক মেকার, টোকাই, হেলপার ও হোটেল বয়সহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি কোটিপতি বনে গেছেন।