আজ হিরুর ডেটিং আছে। ডেটিং বলতে একজন খুব করে চাইছিল হিরুর সাথে ভালো কিছু মুহূর্ত কাটাবে। সেই কবে থেকে সে এজন্য হিরুকে সময় দেবার জন্য বলে আসছে। কিন্তু হিরুর যে সময়ের বড়ই অভাব। এই তো মাত্রই ক’দিন আগে সে রাশিয়া ঘুরে এলো। কিন্তু ‘সময় নেই’ বললেই তো আর সবাই তাকে ছেড়ে দেবে না।
মেয়েটির নাম আশা। সে বহু আশা করে হিরুর সাথে দেখা করার জন্য সময় চাইল।
‘উ-উ, ঠিক আছে। কাল সন্ধ্যায় এসো। ভুংচুং চাইনিজ রেস্টুরেন্টে।’ অনেক ভেবে হিরু মেয়েটিকে ডেটের জন্য ডেট দিলো।
আপনারা আবার কেউ ভেবে বসবেন না—হিরু বুঝি সেই বালিকার টাকায় চায়নিজ খাওয়ার জন্য তাকে অমন জায়গায় যেতে বলেছে! আসল ব্যাপারটা হলো—এমনিতে অকম্মা হলেও, সত্যিই ইদানীং হিরুর বড্ড সময়ের অভাব। আদতে বেকার হলেও পার্কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেকার বসে থাকার মতো বেকার সে নয়। চায়নিজে আসো, দ্রুত খানাপিনা শেষ করে চলে যাও—হিরুর ডেটিং ভাবনা এমনই। মোটা অংকের বিল মেটানোর জন্য সে সতত দু পায়েই খাড়া।
কিন্তু আশা মেয়েটা বোধহয় হিরুর থেকেও এককাঠি বেশি সরেস! সে ওসব চাইনিজ-টাইনিজে যাওয়ার মতো নয়। বলল, ‘তুমি আমাকে বিকেল থেকে টাইম দাও।’
হিরু বলল, ‘উমম, আচ্ছা ঠিক আছে। এত করেই যখন বলছ… সময় মতো ভুংচুং চাইনিজে চলে এসো।’
‘না, চায়নিজে যাব না।’
‘চায়নিজে যাবে না?’ হিরুর মুখটা গোল হয়ে গেল। ডেটিংয়ে চায়নিজে যেতে চায় না—এমন রমণীও আছে নাকি! হিরু বলল, ‘আরে! বিল তো আমিই পেইড করব। ভয় পাচ্ছ কেন?’
‘না চায়নিজে যাব না।’ বালিকা আবারও হিরুকে না করে দিলো।
এবার হিরু কিছুটা ভয় পেল। এক মুহূর্ত ভাবল—চায়নিজের থেকেও খরচের জায়গা কী আছে? মেয়েটা আবার তাকে পথে বসাতে চাইছে না তো? সে জানতে চাইল, ‘তাহলে কোথায় যাবে?’
‘কাল আমরা পার্কে ঘুরব।’
‘চায়নিজের বদলে পার্কের খোলা হাওয়া!’ বিস্ময়ে হিরুর মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে এলো।
‘পার্কে বসে আমরা দুজনে হাওয়াও খাবো, পাশাপাশি বাদামও চিবুব।’
‘তা, স্পট হিসেবে পার্ক ঠিক করলে কেন?’
মেয়েটি কোনো ভণিতা না করে বলল, ‘কোনো চায়নিজ রেস্টুরেন্টে গেলে তো বেশিক্ষণ বসা যাবে না। খাওয়া শেষ হয়ে গেলেই তো তুমিও পগারপার। জোর করে বিদায় দিয়ে দেবে আমাকে। সে কারণেই তোমার সাথে পার্কে যাব। দুজনে বসে বসে বাদাম খাব। বাদাম খাওয়া যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষ হবে, আমাদের ডেটিংও ততক্ষণ চলতে থাকবে!’
আশা মেয়েটা আদতে হিরুর গার্লফ্রেন্ড ক্যাটাগরিতে পড়ে না। হিরু খুব সহজে তার গার্লফ্রেন্ড তথা মেয়ে বন্ধুর কাতারে কোনো মেয়েকে জায়গা দেয় না। আর প্রেমিকা হিসেবে হিরুর মনে স্থান পাওয়া কারোর সাত পুরুষের কপাল। ফেসবুকে আশার প্রোফাইল পিচকারে যে ছবিটা দেওয়া আছে, সেটা একজন নায়িকার। হিরু সেটা জানেও। তবুও সে সেই ছবির মালিক নয়, ছবিওয়ালা আইডির মালিকের ওপর ক্রাশ খেয়ে ফেলে। সেই ক্রাশই একসময় আশা মেয়েটাকে হিরুর প্রতি দুর্বল করে তোলে। সে এখন প্রথমবারের মতো হিরুকে দেখা দিতে চাইছে। প্রথম বলার কারণ হলো—ফেসবুকেও হিরু আশার ছবি দেখেনি কখনো, এমনকি দেখতেও চায়নি। আর সেটাও আশার হিরুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। কাল হিরু আশার সাথে দেখা করতে গেলে দেখবে—সে যার ছবি দেখে এই ফেক আইডিতে ক্রাশ খেয়েছিল, সেই নায়িকার থেকেও আশা কোনো অংশে কম সুন্দরী নয়!
দুই.
আশা নির্ধারিত সময়ে পার্কে গিয়ে দেখে—তার আগেই হিরু এসে বসে আছে! আশা যে লেট করে এসেছে তাও কিন্তু নয়।
‘তুমি! এত তাড়াতাড়ি এসে বসে আছ যে!’ বালিকা তার বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না।
‘আসলে আমার কাছে কাউকে অপেক্ষায় বসিয়ে রাখাটা বেশি প্যারার বলে মনে হয়। ধরো, তুমি বসে আছ। আমি বাসে চড়ে আসতেছি। কিন্তু তখন বাসের মধ্যেই অস্থিরতা শুরু হয়ে যাবে। বাসে তো আর হাঁটাহাঁটিরও জায়গা নাই, তাই পায়চারীও করা যাবে না। আবার ধরো, লেট হচ্ছে বলে কেউ তখন বাথরুমে গিয়েও আরাম পাবে না। তারচেয়ে বরং আগে এসে আরেকজনের প্যারা ফিল করায় মজা আছে!’
‘সেক্ষেত্রেও আমার দুটো কৌতূহল আছে। প্রথমত, আমি লেট করিনি। দ্বিতীয়, তুমি আগে এসে আমাকে ফোন দিয়ে ‘প্যারা’ও তৈরি করোনি। তাহলে তুমি মজা পেলে কী করে?’ আশা জানতে চাইল।
হিরু নিরুদ্বেগভাবে একটা পলিথিন দেখিয়ে বলল, ‘এতক্ষণ ধরে একা একা বাদাম খেয়েছি। তুমি বাদাম খেতে চেয়েছ, আর দেখো—তুমি আসার আগেই প্রাথমিকভাবে কেনা সবগুলো বাদাম আমার পেটে চালান হয়ে গেছে। এটাও তো এক প্রকারের মজা, নাকি!’
আশা পলিথিন ব্যাগের ভিতরে বাদামের খোসাগুলো দেখে সত্যিই হতাশ হয়ে গেল। ‘এতগুলো বাদাম তুমি একাই খেলে?’
‘আরে না! এখানে এসে দেখি—আমার আগে যারা এখানে বসেছিল, তারা মনের সুখে বাদাম খেয়ে খোসা ফেলে রেখে পরিবেশ নষ্ট করে গেছে। আমি ওই খোসাগুলোও এর ভেতরে ভরে রেখেছি!’
‘পার্কে কত্ত লোক কত কত বাদাম খায়। কেউ তো নোংরা হবার কথা ভাবে না!’
‘একজন দুজন করে ভাবলেই হবে। আগে আমি ভাবতাম। আজ থেকে তুমিও ভাববে। দেখো এজন্যই কিন্তু পলিথিন কাগজটা বাসা থেকে পকেটে করে এই অবধি নিয়ে এসেছি।’
হিরুর কথা শুনে আশার চোখ দুটি এবার খোদল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। ‘বাদাম খেয়ে আবার বাদামের খোসাগুলো কেউ সযত্নে ডাস্টবিনেও ফেলে দেয়!’ মনে মনে ভাবল সে। আশপাশে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিলো। কোনো ডাস্টবিন দেখতে পেল না সে।
আশার ভাবগতিক হিরুও খেয়াল করছিল। সে বলল, ‘বাদাম খেয়ে খোসাগুলো তুমি ব্যাগে করে নিয়ে যাবে। পথে কোথাও ডাস্টবিন দেখতে পেলে ফেলে দেবে।’
‘কেন, তুমি নিয়ে যেতে পারবে না?’
‘বারে, আমার কি আর তোমার মতো সাথে কোনো ব্যাগ আছে!’ হিরু তার পক্ষে যুক্তি দেখাল।
আশাও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। সে বলল, ‘তাহলে তুমি ওগুলো হাতে করে নিয়ে যাবে। পাবলিক তোমার সচেতনতা দেখে আরও বেশি সচেতন হবে।’
‘তোমার মতো ভাবিনি ভাবছ?’ হিরু বলল। ‘কিন্তু সমস্যা হলো, পাবলিক এগুলোকে খালি চোখে ময়লা বলে ঠাওর করবে না। তারা ভাববে—এগুলো বাদাম। আমি বুঝি বিক্রি করতে নিয়ে যাচ্ছি। দু-একজন হাঁকও দিয়ে বসতে পারে, এই বাদাম, এদিকে আয়!’
‘না, থাক তোমার নেওয়া লাগবে না।’ আশা ত্বরিত্ বলে উঠল। শেষে মিনমিন করে বলল, ‘কিন্তু, আমার ব্যাগের ভিতরেও যে কোনো জায়গা নেই!’
হিরু বিড়বিড় করে বলল, ‘তা অবশ্য থাকবার কথাও নয়। মেয়েদের ব্যাগ তো এক আস্ত ড্রেসিংরুম। সেখানে কী না থাকে!’
‘আমার ব্যাগে ওসবের কিছুই নেই।’
হিরুর কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। সে আরেকটিবার আশার ভ্যানিটি ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ফের বলল, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না। মেয়েদের ব্যাগে আর কিছু না থাকুক সাজুনি তো থাকবেই। মাস্ট।’
‘না, বললামই তো, ওসবের কিছুই নেই।’ আশা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল।
হিরু এর প্রত্যুত্তরে কিছু না বললেও হাবভাবে বোঝাল—সে এ কথা বিশ্বাস করেনি।
আশা এবার বেশ রহস্য করে বলল, ‘ব্যাগের ভিতরে যা আছে, তা যদি একটিবারের জন্যও বের করি, তাহলে ওগুলো তোমাকে আজ হাতে করে টানতে হবে। আমি আর ভেতরে ঢুকাব না।’
হিরু এতক্ষণে তুমুল আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ দেখার মতো দুর্লভ সুযোগ সে কেন হেলায় হারাবে। বলল, ‘ঠিক আছে, আমি রাজি।’
আশা তার ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর থেকে একটা র্যাপিং পেপার মোড়া প্যাকেট বের করল। সত্যিই, ওটা ছাড়া ভিতরে আর কিছু নেই। একেবারে ফাঁকা। আসলে প্যাকেটটা ভরার জন্যই বালিকাটিকে তার সাধের জিনিসপত্রগুলোকে বাসায় ফেলে রেখে আসতে হয়েছে। হিরুর হাতে প্যাকেটটি ধরিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘এটা তোমার জন্য। বাসায় নিয়ে গিয়ে খুলে দেখবে।’
‘এখানে খোলা যাবে না?’
‘ইচ্ছে। এখানেও খুলতে পার।’
হিরু আর প্যাকেটটা খুলল না। বালিকা যেহেতু মত দিয়েই ফেলেছে, সুতরাং প্যাকেটটাকে আর এখানে খুলে কোনো মজা নেই। বরং না খুলেই বেশি মজা! আশা ভিতরে ভিতরে কিছুটা অস্থিরতায় ভুগবে।
আশা হঠাত্ চিল্লিয়ে উঠল, ‘এই বাদামওয়লা ভাই, এদিকে আসো।’
আশা বাদামওয়ালার কাছ থেকে অনেকগুলো বাদাম কিনল। তা দেখে হিরুর ভিরমি খাওয়ার দশা। ‘মজা নিতে গিয়ে এরমধ্যেই অনেক বাদাম খেয়ে ফেলেছি। আর খেতে পারব না!’ মিনমিন করে বলল সে।
আশা এবার মুচকি করে একটু হেসে বলল, ‘সেটাই তো মজা। তুমি বাদাম খেতে পারবে না। বসে বসে আমার বাদাম খাওয়া দেখবে। অন্যদিকে, আমার জন্য বাদাম ছিলেও দিতে পারবে।