রুপের আড়ালে ভয়ংকর ও বিতর্কিত ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা

বিশ্বকাপ ফুটবলে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোলিন্দা গ্রাবার রুপ ও ফুটবলপ্রেমী হিসেবে সারাবিশ্বের নজর কাড়েন। কিন্তু এই লাস্যময়ী প্রেসিডেন্ট কোলিন্দার কৃতকর্মের বিতর্কিত দিক অনেকের অজানা। ২০১৫ থেকে ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই রাজনীতিবিদ ছিলেন মূলত একজন কূটনীতিবিদ। ন্যাটোতে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। কিছু দিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রোয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। দেশটির দক্ষিণপন্থী ক্রোয়েশিয়া ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (‘এইচডিজেড’ নামে পরিচিত) সদস্য তিনি। এইচডিজেড গড়েছিলেন কমিউনিস্ট যুগোস্লাভিয়া ভাঙার অন্যতম কারিগর ফ্রানজো ট্রডাম্যান। যে কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের খুব প্রিয় ছিলেন তিনি। সেই এইচডিজেডের আজকের নেতা হলেন কোলিন্দা। কিন্তু এইচডিজেডের ভাবাদর্শের রয়েছে কুৎসিত এক অতীত।

আজকের ফুটবলপ্রেমী কোলিন্দা গ্রাবার যে এইচডিজেড দল করেন, সেটা সে দেশের ফ্যাসিবাদী ‘উসতাসা’ আন্দোলনের বর্তমান উত্তরাধিকারী। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত এরাই হাজার হাজার ভিন্নমতাবলম্বীকে হত্যা করেছিল। ক্রোয়েট ‘বিশুদ্ধতা’ রক্ষা করতে ‘উসতাসা’ সদস্যরা গণহত্যাকেও সমর্থন করত। যে গণহত্যার টার্গেট ছিল যুগোস্লাভিয়ার সার্ব, ইহুদি, মুসলমান এবং রোমা জিপসিরা। ১৯৪১-৪৫ সময়ে এরা হিটলার ও নাজিদের অন্যতম সহযোগী ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও ইতালির যুদ্ধজোটেও ছিল তারা। হিটলারের বাহিনী যুগোস্লাভিয়ার ওই অঞ্চল দখল করে ১৯৪১-এর ১০ এপ্রিল তাদের ক্রোয়েট সহযোগীদের একটি সরকার গড়ে দিয়েছিল, তা চার বছর স্থায়ী হয়। আজকের ক্রোয়েট ফুটবল উত্তেজনায় মিশে আছে সেই রক্তাক্ত অতীত। এখনো ক্রোয়েট ফুটবল দর্শকেরা উত্তেজনার বশে স্লোগান দেয়: ‘ফর দ্য হোমল্যান্ডরেডি!’ এটাই ছিল উসতাসা আন্দোলনের শপথ। রাজনৈতিক প্রয়োজনেই তাই গ্যালারি থেকে ড্রেসিংরুম পর্যন্ত কোলিন্দা গ্রাবারকে ফুটবল উত্তেজনায় থাকতে হয়েছে। প্রায়ই সুযোগ পেলে তিনি এও বলেন, মার্কো পারকোভিচের ভক্ত তিনি। ক্রোয়েট এই পপগানের শিল্পী ওই অঞ্চলে তরুণদের উগ্র জাতীয়তাবাদে আসক্ত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থানে তিনি নিষিদ্ধ।

ক্রোয়েট ফুটবলের এই উগ্র জাতীয়তাবাদীতা এবং ক্রোয়েট দর্শকদের বর্ণবাদী আচরণের জন্য ২০০৬-এ ইউরোপীয় ফুটবল এসোসিয়েশন দেশটিকে একদা বহিষ্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিল্ ২০০৪-এও একই অভিযোগে ক্রোয়েট ফুটবল এসোসিয়েশনকে জরিমানা করা হয়।

এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ফ্যাসিবাদী অতীত, ফুটবল এবং পপ মিউজিককে ব্যবহার করে কোলিন্দা এখন উগ্র ক্রোয়েট জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। গোপনে তাই তাকে অস্ট্রিয়া গিয়ে উসতাসা কর্মীদের একটি গোপন সমাধিক্ষেত্রও সফর করতে হয়েছিল একদা। বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামে যাওয়ার মতোই ফ্যাসিবাদী সহযোদ্ধাদের সমাধিক্ষেত্রকে সম্মান জানানোও তার রাজনীতির জন্য জরুরি হয়ে ওঠে।

কোলিন্দাকে এ মুহূর্তে দক্ষিণপন্থী এক বিপ্লবেরই প্রতীক বলা যায় আর তার বড় শক্তি ক্রোয়েট ফুটবল দর্শকদের একাংশ। ক্রোয়েট দর্শকরা আইনগত বাধ্যবাধকতা এড়াতে প্রায় স্টেডিয়ামে নাজিদের স্বস্তিকা চিহ্নসংবলিত পতাকা হাতে না নিয়ে স্বস্তিকার মতো করে গ্যালারিতে বসেন ।

লিন্দা যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত থাকাকালে স্বামী জ্যাকবকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করতে দিয়ে ধরা পড়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে পদ ছেড়ে এরপর তিনি যোগ দেন ন্যাটো দপ্তরে। আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর ইমেজ বৃদ্ধি এবং সৈনিকদের মনোবল বাড়ানোই ছিল তার মূল দায়িত। আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের আগ্রাসনে ক্রোয়েট সৈন্যরাও ছিল এবং আছে। ন্যাটোতে থাকাকালেই কোলিন্দা গ্রাবার যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ব্যবসায়ী ডেভিড রকিফেলোর প্রতিষ্ঠিত ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’-এর সদস্য মনোনীত হন। আমেরিকার বৈশ্বিক প্রাধান্য তৈরি এবং ৯/১১ পরবর্তী পরিস্থিতি সৃষ্টির অন্যতম কারিগর এই ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’।

ন্যাটো এবং ‘ট্রাইলেটারাল কমিশন’-এ কাজের অভিজ্ঞতা কোলিন্দা গ্রাবারকে আমেরিকান এস্টাবলিশমেন্টের খুব কাছে নিয়ে এসেছিল। তারই ফসল তার প্রেসিডেন্ট হওয়া। তবে সামাজিক গণতন্ত্রীদের চেয়ে মাত্র ১ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন তিনি। ব্যবধান আরও বাড়াতে এমুহূর্তে কোলিন্দা নিজেকে ইউরোপজুড়ে বেড়ে ওঠা উগ্র দক্ষিণপন্থী ঢেউয়ে নিজেকে শামিল করেছেন। ট্রাম্প ও পুতিন উভয়েরই ঘনিষ্ঠতা চাইছেন তিনি। টিম-ক্রোয়েশিয়াকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘায়িত করতেও তিনি মরিয়া।