সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে না পারায় উচ্চ আদালতের যে রায়ের কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সেটি এসেছে আরও ছয় বছর আগে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের মীমাংসাও হয়ে গেছে তিন বছর আগে।
২০১২ সালের ৫ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধা সংক্রান্ত একটি রিট আবেদন কিছু পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে নিষ্পত্তি করে দেয় হাইকোর্ট। বিচারপতি মামনুন রহমান এবং বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বঞ্চের এই রায়ে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য চাকরিতে ৩০ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণ (কোটা) অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের নিয়োগের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে জানিয়ে রায়ে আরও বলা হয়, কোনো ক্ষেত্রে কোটা পূরণ যদি সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে পদ খালি রাখতে হবে।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ২০১৫ সালের ৩১ আগস্ট আপিল বিভাগ হাইকোর্টের ওই রায়ের পর্যবেক্ষণের কিছু অংশ বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে দেয়। আপিলের রায়েও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য চাকরিতে ৩০ শতাংশ সংরক্ষণের (কোটা) বিষয়টি বহাল রাখা হয়।
তবে কোটা পূরণ সম্ভব না হলে পদ খালি রাখার যে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছিল তা বাদ দিয়ে দেয় আপিল বিভাগ।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত এপ্রিলে তুমুল আন্দোলনের মুখে কোটা বাতিলের ঘোষণা আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে। তবে গত ১১ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, এই মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। আর পরদিন প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল হলে আদালত অবমাননা হবে।
কোটা বাতিল বা সংস্কার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কমিটি কাজ করার মধ্যে উচ্চ আদালতের রায়ের প্রসঙ্গটি সামনে আসায় এটা স্পষ্ট যে সংস্কার যাই হোক, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় হাত দিচ্ছে না সরকার। আর বাকি কোটার কী সংস্কার হয়, সে বিষয়ে কোটা কমিটিতে ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে যে কোটা রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোটা আছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। ১৯৭২ সাল থেকেই এই কোটা সংরক্ষণ করা হয়। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদেরকেও এই কোটার আওতায় আনা হয়। পরে তা নাতি নাতনিদেরকে দেখা হয়।
আর তখন থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি তুলে প্রধানত জামায়াত-শিবিরের অনুসারীরা। সে সময় ব্যর্থ হওয়ার পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবারও এই দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন শুরু হয়। এরপর ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে বছর ২০১৩ সালে আবার সে সময় এ নিয়ে শোরগোল শুরু হয়।
তবে চলতি বছর বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে কর্মসূচিতে কোনো বিশেষ কোটার নাম উল্লেখ না করে সব মিলিয়ে কোটা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানানো হয়। তবে বিভিন্ন কর্মসূচিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়েই কথা বলতে থাকে কর্মসূচিতে অংশ নেয়া ছাত্ররা।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আদালতের রায় থাকলে সেই রায় রিভিউ না করা পর্যন্ত কিছু করা যাবে না। আগে রিভিউ করতে হবে। তা না হলে আদালতের রায় অনুযায়ী করতে হবে।’
তবে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন ইচ্ছাধীন। আর ২০১৫ সালে আপিল বিভাগ রায় দেয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ আর সেটি রিভিউ করার আবেদন করেনি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মাহবুব উদ্দীন খোকন অবশ্য মনে করেন, আদালতের রায়ের পরও সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের বিষয়টি সরকারের ইচ্ছাধীন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘কোটা রাখা না রাখার বিষয়টি সরকারের নীতি। সরকারের নীতি নির্ধারণে আদালতের রায় কোনো বাধা নয়। সরকার যদি চায় ১০০ শতাংশ কোটা রাখবো তাহলে সেটা সে করতে পারে, আবার যদি না রাখে বা ২০ শতাংশ রাখে সেটাও সে রাখতে পারে। এছাড়া কোন রায় থাকলে সরকার চাইলে সেটা রিভিউয়ের আবেদন করতে পারে।’
তবে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করলে রায় পরিবর্তনের ইতিহাস নেই বললেই চলে। আদালত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রায়ে বড় ধরনের ত্রুটি থাকলেই কেবল রিভিউয়ে পরিবর্তন হয়ে থাকে।–ঢাকাটাইমস