আগামী ১৪ জুলাই হজ ফ্লাইট শুরু হবে। ইতিমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২১ আগস্ট পবিত্র হজ পালিত হবে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক হজযাত্রী সৌদি আরবে হজ প্রতিপালনের জন্য গমন করেন। বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ হজযাত্রী প্রেরণকারী দেশ। বেসরকারি হজযাত্রী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে প্রথম।
এবছর বাংলাদেশ থেকে ১,২৭,১৯৮জন হজযাত্রী হজে গমন করবেন। তার মধ্যে ১,২০,০০০জন হজযাত্রী বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় অর্থাৎ হাব এর সদস্য ৫২৮টি হজ এজেন্সির মাধ্যমে হজে গমন করবেন। বাকি ৭,১৯৮জন সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে গমন করবেন। এই বিশাল সংখ্যক হজযাত্রীগণকে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের সকল আইন-কানুন মেনে নির্দিষ্ট সময়ে গমন এবং প্রত্যাবর্তন, মিনা, আরাফা, মুজদালিফা, জামারা, তাওয়াফ, সায়ী, পবিত্র মদিনায় গমন ইত্যাদি সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সময় মতো স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। এর মধ্যে আহার, বাসস্থানসহ সম্ভাব্য সকল স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা, হজযাত্রীগণের মধ্যে ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন প্রকার পছন্দ, ইচ্ছা, চিন্তা ও রুচির সমন্বয় সাধন করে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা একটি দুরূহ ব্যাপার। সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, আল্লাহর অশেষ রহমতে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা সম্ভব হয়।
হজের মত একটি কষ্টসাধ্য ইবাদতকে প্রতিপালনের বিষয়ে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি হজযাত্রীগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
হজযাত্রীগণ সরাসরি হজ্জ এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে হজযাত্রার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হবেন-
বিগত বছর গুলিতে দেখা গেছে যে, অনেক হজযাত্রীগণ হজে যাওয়ার প্রক্রিয়া মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে সম্পন্ন করার কারণে কেউ কেউ প্রতারিত বা বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। অনেক সময় মধ্যস্বত্বভোগীগণ হজযাত্রীদের টাকা খরচ করে ফেলেন এবং এজেন্সিকে পরিশোধ করেন না। হজযাত্রীগণ এজেন্সির ব্যাংক একাউন্টে অথবা এজেন্সির অফিসে টাকা জমা দিয়ে মানি রশিদ সংগ্রহ করে, বাসস্থান এবং অন্যান্য সুবিধার বিষয়ে অবগত হয়ে সরাসরি হজ এজেন্সির সাথে চুক্তিবদ্ধ হবেন। বেসরকারি হজযাত্রীগণ হাব কর্তৃক নির্ধারিত সর্বনিম্ন প্যাকেজ মূল্যের নিম্নে হজে গমন করতে যাতে কারো সাথে চুক্তিবদ্ধ না হন।
বিমান টিকেটের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে বাড়ী থেকে হজের উদ্দেশ্যে বের হবেন-
হজযাত্রীগণ এয়ার লাইসেন্স টিকেটের বিষয়ে সরাসরি এজেন্ট থেকে নিশ্চিত হয়ে হজযাত্রার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের হবেন। অনেক হজযাত্রীগণ মধ্যস্বত্বভোগীদের খপ্পরে পড়ে এবং তাদের প্ররোচনায় হজযাত্রার টিকেটের বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে আশকোনা হজ্জ ক্যাম্পে চলে আসেন এবং অনেক বিড়ম্বনার মধ্যে পতিত হন। পাসপোর্ট, বিমান টিকেট, ভিসার কপি এবং আইডি কার্ড ইত্যাদি হজের উদ্দেশ্যে যাত্রার পূর্বে বুঝে নিবেন। এ বছর থেকে হজযাত্রীদের পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের বিষয়টি বাতিল করা হয়েছে।
হজযাত্রার প্রারম্ভেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ-
হজযাত্রীগণ হজের উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের হয়ে নিজ জেলা থেকে দীর্ঘ যাত্রার পর আশকোনা হজ্জ ক্যাম্পে উপস্থিত হন। সেখানে ১/২ দিন অতিবাহিত করার পর সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে প্রায় ৬ঘন্টা বিমান ভ্রমণের পরে ক্লান্ত অবস্থায় সৌদি আরবের বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। জেদ্দা ইমিগ্রেশনে অনেক সময় হজযাত্রীদেরকে ৩-৬ঘন্টা কখনোবা ৮-১০ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ইমিগ্রেশন থেকে বের হওয়ার পর আবারও মোয়াল্লেমের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই দীর্ঘ যাত্রায় বাড়ী থেকে বের হয়ে আশকোনা হজ্জ ক্যাম্পে অবস্থান ও অপেক্ষা, বাংলাদেশের এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনের অপেক্ষা, তারপরেই দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের পরে সৌদি আরবে অবতরণ করে সৌদি ইমিগ্রেশনে দীর্ঘ অপেক্ষা, ইমিগ্রেশনের পরেই মোয়াল্লেম বাসের জন্য অপেক্ষাসহ দীর্ঘ অপেক্ষার শারীরিক পরিশ্রমের জন্য সকল হজযাত্রীগণকে পূর্ব থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। ইমিগ্রেশনে ও মোয়াল্লেম বাস প্রাপ্তিতে দেরির বিষয়টি লাঘবে বাংলাদেশ সরকার বা ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় অথবা এজেন্সির কিছুই করার থাকেনা।
হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার কষ্টের বিষয়ে মানসিক প্রস্তুতি-
হজ একটি কষ্টসাধ্য ইবাদত। এর জন্য শারীরিক সক্ষমতা অত্যাবশ্যক। বিশেষত মিনা, আরাফা, মুজদালিফায় অবস্থান ও যাতায়াতের বিষয়টি খুবই কষ্টসাধ্য বিধায় সকল হজযাত্রীদেরকে এ কষ্টের বিষয়ে পূর্ব থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। ৮ই জিলহজ্ব যোহরের নামাজের পূর্বে মিনার তাবুতে পৌঁছানোর বিধান রহিয়াছে। পবিত্র মক্কা শরীফের হোটেল থেকে মিনায় নিয়ে যাওয়া এবং মিনায় রাত্রি যাপনের পর সেখান থেকে আরাফায় পৌঁছানো। ৯ই জিলহজ্ব আরাফার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মুজদালিফায় পৌঁছানো। মুজদালিফায় রাত্রি যাপনের পরে মিনার তাবুতে নিয়ে আসাসহ সকল যানবাহন নিশ্চিত করা, মিনা, আরাফায় খাবার সরবরাহসহ এসকল সেবা প্রদানের জন্য সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত মোয়াচ্ছাসার অধীনস্থ মোয়াল্লেমদের দায়িত্ব। অর্থাৎ হজযাত্রীগণকে পবিত্র মক্কা শরীফের হোটেল থেকে মিনায় নেয়া, মিনা থেকে আরাফায় নেয়া, আরাফা থেকে মুজদালিফায় নেয়া এবং পুনরায় মিনার তাবুতে ফিরিয়ে আনা, জামারাতের আনুষ্ঠানিকতাসহ হজের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পবিত্র মক্কা শরীফের হোটেলে ফিরিয়ে আনা পর্যন্ত সকল বাস সার্ভিস, খাবার ও তাবু ইত্যাদি সৌদি আরবের মোয়াচ্ছাসার অধীনস্থ মোয়াল্লেমদের দায়িত্ব। বাংলাদেশ সরকার, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, হাব বা হজ এজেন্সির এই বিষয়ে কিছুই করার থাকে না, শুধুমাত্র মোয়াচ্ছাসার অধীনস্থ মোয়াল্লেমদেরকে অবহিত বা যোগাযোগ করা ছাড়া। মিনা, আরাফা, মোজদালিফায় ভারি খাবার কম গ্রহণ করা এবং প্রচুর পরিমাণ পানি পান করা উচিত। এসকল স্থানে টয়লেট ব্যবহারের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। বিশেষত ফজরের নামাজের পূর্বে কমপক্ষে ৩০মিনিট এবং অন্যান্য সময়ে কমপক্ষে ২০মিনিট টয়লেট ব্যবহারের জন্য লাইনে অপেক্ষা করতে হয়।
হজযাত্রী হারানো প্রসঙ্গে-
হজে গমনকারী অনেক হজযাত্রীগণ গাইডকে অনুসরণ না করার কারণে মিনা, আরাফা, মুজদালিফা, হেরেম শরীফ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় হারিয়ে যান। হজযাত্রীগণকে তাঁহার হজের আইডি কার্ড সবসময় গলায় ঝুলিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ করা হল। বিশেষ করে মিনার তাবু নম্বর, সড়ক নম্বর, ব্লক নম্বর এবং মোয়াল্লেম নম্বর সংরক্ষণ করুন। কেউ হারানো গেলে আতংকিত না হয়ে হজ আইডি কার্ডটি নিকটস্থ কোন স্বেচ্ছাসেবককে প্রদর্শন করলে সেই স্বেচ্ছাসেবক তাহাকে মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশনে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশনে হাব এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হেল্প ডেস্ক আছে। সেখানে হাজী সাহেবগণদের জন্য তাৎক্ষনিক প্রয়োজনীয় আহার, পানীয়, সেবা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে এবং সংশ্লিষ্ট এজেন্সির নিকট হারিয়ে যাওয়া হজযাত্রীকে দ্রুততম সময়ে প্রেরণ করা হয়।
হজযাত্রীগণ নিজের ইচ্ছামত হজযাত্রার তারিখ ও ফিরতি তারিখ নির্ধারণ না করা-
অনেক সময় হজযাত্রীগণ নিজের সুবিধামত হজযাত্রার তারিখ ও প্রত্যাবর্তনের তারিখ নির্ধারণের ইচ্ছা পোষণ করেন যা সুশৃঙ্খল হজ ব্যবস্থাপনায় জটিলতা সৃষ্টি করে। যেহেতু হজযাত্রা একটি গ্রুপভিত্তিক মুভমেন্ট এবং ২টি রাষ্ট্রের বহুবিধ নিয়ম-কানুন মেনে পালন করতে হয়, তাই নিজের ইচ্ছা মাফিক তারিখ নির্ধারণ না করে গ্রুপের বেধে দেয়া তারিখের সাথে নিজে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা উচিত।
হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য সেবা-
বাংলাদেশের সকল হজযাত্রীদের চিকিৎসা সেবার জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্টসহ একটি স্বাস্থ্যসেবা দল মক্কা এবং মদিনায় হজযাত্রীদের সেবার জন্য সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকে। ডাক্তারি পরামর্শ, ডায়াগনোসিস, প্রয়োজনীয় ঔষধসহ সকল প্রকার সুবিধাদি বিদ্যমান থাকে। তাছাড়াও কোন হজযাত্রীর হাসপাতালে ভর্তি এবং উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তাৎক্ষনিক ভাবে মক্কা বা মদিনার উন্নত হাসপাতালে বিনা খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।
ব্যাগেজ-
সকল হজযাত্রীগণ ২টি লাগেজে সর্বোচ্চ ২৩কেজি করে ৪৬কেজি ওজনের মালামাল বহন করতে পারবেন। এছাড়া ৭কেজি ওজনের ১টি হাত ব্যাগ বহন করতে পারবেন। লাগেজের ওজন এর বেশি হলে হজযাত্রীদেরকে এয়ারপোর্টে বিড়ম্বনায় পরতে হবে।
হজ একটি কষ্টসাধ্য ইবাদত। এর জন্য আর্থিক, শারীরিক সক্ষমতা ও ধৈর্য ধারণ অত্যাবশ্যক। উপরোল্লিখিত সকল বিষয়ে অবহিত হয়ে, হজের মাসয়ালা মাসায়েল সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আহরণ করে হজযাত্রার বিষয়টি নিশ্চিত করা উত্তম।