ঝটিকা সফরে শুক্রবার রাতে ঢাকা আসছেন রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউরি ইভানোভিচ বরিসভ। মস্কোর গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর হাইপ্রোফাইল ওই সফরের প্রস্তুতি শুরু করেছে ঢাকা। কর্মকর্তারা বলছেন- এই প্রথম রাশিয়া সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো অতিথি বাংলাদেশে আসছেন।
তার সফরটি হবে ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের। প্রস্তুতি এবং অবস্থানে সময়ের ব্যাপ্তি বিবেচনায় রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রীর সফরটি সংক্ষিপ্ত এবং ঝটিকা হলে নির্বাচনী বছরে তার আগমণকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। ঢাকায় বাংলাদেশ ও রাশিয়ার সম্পর্ক বিষয়ক গতকালের এক সেমিনারে অংশ নেয়া দুই দেশের পেশাদার কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ ও গবেষকরা এমনটাই ধারণা দিয়েছেন। তাদের মতে, পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়ন আজকের রাশিয়া বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত।
যুদ্ধবন্ধু রাশিয়া একাত্তরে জাতিসংঘে ভেটো না দিলে চীন ও পাকিস্তান তথা আন্তর্জাতিক রাজনীতির চক্করে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় ঘোষণা পিছিয়ে যেত।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরে শত্রুদের পুঁতে রাখা মাইন অপসারণ এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত এ ভূখণ্ডের পুনর্গঠনে রাশিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। ঢাকার কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা বলেন, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তায় দুর্দিনে পাশে থাকা রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ৪৬ বছরে যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেভাবে এগোয়নি। এখন সময় এসেছে এটাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। সেই সম্পর্কে ভিন্নমাত্রা দিতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর বলে জানান সেমিনারের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। বাংলাদেশ-রাশিয়া মৈত্রী সমিতি আয়োজিত ঢাকা ক্লাবের ওই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
বক্তৃতা করেন মস্কোতে নয় বছর ধরে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. সাইফুল হক। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মৈত্রী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ শিকদার। ঢাকাস্থ রাশিয়ান দূতাবাস ও কালচারাল সেন্টারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সেমিনারে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠান শেষে রাষ্ট্রদূত ড. সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী বা শীর্ষ কোনো প্রতিনিধির সফর তো দূরের কথা স্বাভাবিক সম্পর্ক এগিয়ে নেয়াই কঠিন হয়ে পড়েছিল। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকার এ সম্পর্কের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান বলেন, প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেই সময় এমন কিছু আইন করেছিলেন যাতে বাংলাদেশ-রাশিয়া মৈত্রী সমিতির কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। তার মতে, এখন আর সেদিন নেই।
এখন আর এ সম্পর্ক কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। রাজনীতিক আবদুল মান্নান আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, এখন যদি কেউ আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে নষ্ট করতে চায়- তা ঠেকাতে প্রয়োজনের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমরা ফের রক্ত দেবো। একজন বাঙালি বেঁচে থাকতে এ বন্ধন আর কেউ ভাঙতে পারবে না। রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতসহ ঢাকার কর্মকর্তারা জানান, বিশেষ বিমানে চড়ে রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ১৩ই জুলাই রাতে ঢাকায় পৌঁছাবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তাকে বিমান বন্দরে স্বাগত জানাবেন। পরদিন দুপুরে হেলিকপ্টারে চড়ে উপপ্রধানমন্ত্রী বরিসভ পাবনা যাবেন। সেখানে নির্মিত দেশের প্রথম রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম দেখাবেন তিনি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যৌথভাবে ওই কেন্দ্রের দ্বিতীয় ফেজের উদ্বোধন করবেন তিনি। ২০১৮ সালের মে মাসে উপপ্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর বরিসভ রূপপুরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন। সেখানে নিশ্চিতভাবেই দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হবে। নির্বাচনী বছরের ওই সফরে সমসাময়িক রাজনীতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়েও কথা হবে বলে জানানো হয়েছে।
প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ শিল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপ্রধানমন্ত্রী ইউরি বরিসভ রাশিয়ার অন্যতম নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক হিসেবে খ্যাত। টানা ৪০ বছর ধরে তিনি নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করেছেন। উপপ্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে দেশটির প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য উপমন্ত্রী ছিলেন তিনি। মিলিটারি প্রতিষ্ঠানে স্কুলিং হওয়া বরিসভ রেডিও ইলেক্ট্রনিক্স ও গণিত শাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন। প্রায় ২০ বছর (১৯৭৮-৯৮) পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়া উভয় সশস্ত্র বাহিনীতে। পরবর্তীকালে কাজ করেছেন দেশটির ফেডারেল এজেন্সিতে। সেখানে তিনি উপপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আগে তিনি মস্কোর সামরিক শিল্প কমিশনের সদস্যও ছিলেন।