তদন্ত প্রতিবেদন কতোটা কার্যকর?

নগরীর মেহেদীবাগের ম্যাক্স হাসপাতালে আড়াই বছরের শিশু রাফিদা খান রাইফার মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত কমিটি নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে।
গত ২৯ জুন রাতে ম্যাক্স হাসপাতালে সাংবাদিক রুবেল খানের শিশু কন্যা রাইফার মৃত্যু হয়। শিশুটির মৃত্যুর পেছনে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলা ও ভুলের অভিযোগ তোলেন স্বজনরা।
এ ঘটনায় স্বাস’্য অধিদপ্তর, ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে মোট তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এরমধ্যে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। স্বাস’্য অধিদপ্তর ও ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনো তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
কিন’ এই তিনটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস’া নেওয়া নিয়ে জটিলতা ও সংশয় দেখা দিয়েছে। কেননা তিনটি তদন্ত কমিটির ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার অভিযোগ তদন্ত করার আইনগত ভিত্তি নেই। কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার অভিযোগে ব্যবস’া নিতে পারে কেবল বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। বিএমডিসির ‘শৃঙ্খলা কমিটি’ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে মেডিক্যাল টিম গঠন করে এই অভিযোগ তদন্ত করে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ পেলে অভিযুক্ত চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল কিংবা প্র্যাকটিসের অনুমতি বাতিল করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
শিশু রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস’্য অধিদপ্তর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার বা অবহেলার অভিযোগ তদন্ত করার সুযোগ নেই। তারা কেবল হাসপাতালের ব্যবস’াপনা নিয়ে তদন্ত করার এখতিয়ার রাখেন। ম্যাক্স হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের নেতৃত্বাধীন গঠিত দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেরও কার্যত কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। যদিও সিভিল সার্জনের নেতৃত্বাধীন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রকাশিত প্রতিবেদন বিএমডিসিতে প্রেরণ করার কথা বলেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

কিন’ সিভিল সার্জনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদন কি আমলে নেবে বিএমডিসি ?
বিএমডিসির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র কাছে গতকাল ফোনে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমাদের শৃঙ্খলা কমিটি বিবেচনা করতে পারে। কিন’ ওই প্রতিবেদনের কার্যত কোনো ভিত্তি নেই। ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে বিএমডিসিতে আবেদন করতে হবে। এরপর আমরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে মেডিক্যাল টিম গঠন করে ঘটনার চুলচেরা তদন্ত করবো। এরপর আমরা তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষ অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস’া নেবো।’
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এর জবাবে বললেন, ‘এটা তো প্রীতি ম্যাচ। সাংবাদিক ও বিএমএ নেতৃবৃন্দের অনুরোধে আমি এই ম্যাচে রেফারির দায়িত্ব পালন করেছি। এই তদন্তের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে সাংবাদিক নেতাদের কেউ আমার কাছে জানতে চাইলে আমি বলতাম। কিন’ তারা তো কেউ আমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চায়নি। আমি গায়ে পড়ে তাদের কেন বলবো ?’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএমএ চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান বলেন, ‘বিএমডিসি প্রয়োজন মনে করলে এই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমলে নেবে। তারা যদি এটা আমলে না নেয় তাহলে তো আমাদের করার কিছু নেই।’
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌসের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের প্রাথমিক পদক্ষেপ। পরবর্তী আইনগত যেসব প্রক্রিয়া আছে আমরা তা অনুসরণ করে রাইফার মৃত্যুর জন্য দায়ী চিকিৎসকদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবো।’
কিন্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অবহেলা বা ভুলের অভিযোগের তদন্ত নিয়ে বিএমডিসির নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র দুজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে শুক্রবার প্রকাশিত সিভিল সার্জনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়েছে।
প্রতিবেদনের ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান রায় চৌধুরী শিশুটিকে যথেষ্ট সময় ও মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করে দেখেননি।’
কিন’ এরআগে প্রতিবেদনের তিন নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘তদন্তে দেখা যায়, মৃত শিশুকন্যাকে ভর্তিকালীন সময় হতে পরবর্তী যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে তাতে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ব্যবস’াপত্র ও ওষুধ প্রয়োগ যথাযথ ছিল।’

প্রতিবেদনে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান রায় চৌধুরী, ডা. দেবাশীষ সেন গুপ্ত ও ডা. শুভ্র দেবকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের শাস্তির সুপারিশ করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনের এই অসঙ্গতির বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান জেলা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে অসঙ্গতির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি।’