কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রক্টর কার্যালয় ঘেরাও করেছে নিপীড়ন বিরোধী ছাত্ররা। মঙ্গলবার (৩ জুলাই) দুপুরে টিএসসিতে সমাবেশ করে নিপীড়ন বিরোধী ছাত্ররা। এরপর মিছিল নিয়ে প্রক্টর অফিসের সামনে যায় শিক্ষার্থীরা।
এসময় শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের বলেন, এদেশ কাউকে ইজারা দেয়ার জন্য মানুষ স্বাধীন করেনি। আমার জীবন কারো হাতে তুলে দেয়ার জন্য আমার পূর্বপুরুষ এদেশ স্বাধীন করেনি। এই দেশের মালিক কোনো দল নয়। এদেশের মালিক জনগণ। এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা।
মানবনবন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা কী ভয়াবহ অবস্থায় বেঁচে আছি, যেখানে কথা বললেই আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে, আপনাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় পেটাবে, বন্দুকযুদ্ধ শুরু করবে এবং আপনি গুম হয়ে যাবেন। এই হলো আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেখানে ছাত্রলীগ দাবি করে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। তারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। দল মত নির্বিশেষে এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যারা বিরোধীতা করেছিলো তারা ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, গত শনিবার বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলন ডাকে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূরসহ সাত শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর রোববার কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক নেতা রাশেদ খানকে মিরপুর থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ।
এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর সোমবার সকালে আবার হামলা হয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে জড়ো হতে গেলে ছাত্রলীগের কর্মীরা হামলা চালান। তাঁদের কিল, ঘুষি, লাথি মেরে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। এতে সেখানে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী। তাঁদের মধ্যে ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, স্কুলছাত্র–বিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদিন, মহসীন হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানিসহ বেশ কয়েকজনকে দেখা গেছে।
সোমবার ঢাকাসহ সারা দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কর্মসূচি ছিল। কিন্তু সকাল থেকেই সেখানে ছাত্রলীগের মহড়া ছিল। তাই আন্দোলনকারীরা শাহবাগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানেও একই অবস্থা দেখা গেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেনের নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জন আন্দোলনকারী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে জড়ো হতে শুরু করেন। এ সময় ছাত্রলীগের ১৫ থেকে ২০ জন নেতা–কর্মী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। ফারুক হোসেনকে মোটরসাইকেলে করে তুলে শাহবাগ থানায় নিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, বেলা ১১টা ৫ মিনিটের দিকে আবার ৮ থেকে ১০ জন আন্দোলনকারী ব্যানার নিয়ে শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়ান। এ সময় তাঁদের ওপরেও সাইফ বাবু, জয়নাল আবেদিন ও মেহেদী হাসান সানিকে হামলা চালাতে দেখা যায়।
সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, ‘আমরা সকালে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এ সময় ছাত্রলীগ হামলা চালায়। এতে আমিসহ ১০-১২ জন আহত হয়েছে। ফারুক হোসেনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা পরে কী কর্মসূচি দেব, তা জানানো হবে।’
গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে মানববন্ধন কর্মসূচি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হওয়ার কারণে গতকাল সেখানে কর্মসূচি পালন করা হয়নি।সোমবার ঢাকাসহ সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিক্ষোভ কর্মসূচির ছিল।
ইংরেজি বিভাগের মানববন্ধন
গত শনিবার সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় ব্যাপক মারধরের শিকার হন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী। এই হামলার জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ ও বিচারের দাবিতে সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে অপরাজেয় বাংলার সামনে মানববন্ধন করেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকও। তাঁরা সেখানে ১০ মিনিটের মতো অবস্থান নেন।
মানববন্ধনে শিক্ষক তাসনিম সিরাজ মাহবুব বলেন, ‘আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। আমরা নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই। আমরা চাই আমাদের শিক্ষার্থীরা নিরপেক্ষভাবে মত প্রকাশ করতে পারুক।’
শনিবার সবচেয়ে বেশি মারধরের শিকার হন যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক। তাঁর নাক-মুখ ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল। তিনি অধ্যাপক জাবেদ আহমদের পা জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি জানাতে থাকেন। ওই শিক্ষক নিজের পরিচয় দিয়ে ছাত্রটিকে রক্ষার চেষ্টা করলেও হামলাকারীরা নিবৃত্ত হননি। বরং নিজের হাতে আঘাত পান অধ্যাপক জাবেদ। মারধরের শিকার আহত নুরুলকে হাসপাতালে নিতেও বাধা দেন হামলাকারীরা। পরে তাঁকে পেছনের দরজা দিয়ে হাসপাতালে নেওয়া হয়।