সদ্য সমাপ্ত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাথমিক হিসাবে রাজস্ব আদায় বেড়েছে পূর্বের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ। এর আগের পাঁচ বছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ছিল গাড়ে ১৪ শতাংশের চেয়ে বেশি। বিগত অর্থবছরে রাজস্ব আদায় বাড়াতে এনবিআরের এমন সাফল্য সত্বেও লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে। এনবিআরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে আয়কর, ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ও শুল্ক মিলে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আলোচ্য অর্থবছরে কমিয়ে আনা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায় ঘাটতি অন্তত ১৯ হাজার কোটি টাকা। আর বছরের শুরুতে নেওয়া রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সেই বিবেচনায় কেবল এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ৪২ হাজার কোটি টাকা!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধির চিত্র সন্তোষজনক। তবে জনবল ও সক্ষমতা বাড়ানো গেলে এ প্রবৃদ্ধি আরো বাড়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এত বিশাল ব্যবধান স্বাভাবিক নয়। এর পেছনে বছরের শুরুতে অস্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রা ধরাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনযোগ্য নয় বলে ওই সময় আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এনবিআর ও এনবিআর বহির্ভূত মিলিয়ে সার্বিক রাজস্বে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, সিপিডি গত অর্থবছরের শুরুতে যে আশঙ্কা করেছিল, সেটিই সত্যি হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রা ও আদায়ে এমন বিশাল ফারাক থাকার কারনে রাজস্ব কাঠামোই দুর্বল হয়ে যায়। সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাবে ব্যত্যয় ঘটে। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ে ২০ শতাংশের মত প্রবৃদ্ধি হতে পারে। লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিত। তবে এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, ফাঁকি বন্ধ করা, ই-ফাইলিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, মামলায় আটকে থাকা রাজস্ব আদায়ে উদ্যোগী হওয়ার মাধ্যমে আদায় আরো বাড়ানো সম্ভব।
নতুন করে শুরু হওয়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। সেই বিবেচনায় গত অর্থবছরের বছরের আদায়ের উপর বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় প্রায় ৪৪ শতাংশ, যা কার্যত অসম্ভব। স্বাধীনতার পর কখনোই এই হারে রাজস্ব আদায় বাড়েনি। সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০০৭-০৮ অর্থবছরে, ২২ শতাংশ। ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, এত বিশাল লক্ষ্যমাত্রাও এবার অর্জন করা সম্ভব হবে না। আর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ জি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, অর্থবছরের শুরুতে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা নেওয়ার মাধ্যমে এক ধরণের বাহাবা নেওয়া হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। বছরের শেষ দিকে এসে লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে কমিয়ে আনতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আস্থা হারাবে।
বিশাল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি ছিল। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাও অনেক বেশি। তবে আমরা ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছি।