ঈসা ইবনে মূসা হাশেমী ছিলেন খলিফা মানসুরের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য গর্ভণর। এই গর্ভনরের স্ত্রী ছিল ভুবনমোহিনী রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারী। আল্লাহ পাক যেন নিজ হাতেই তৈরি করেছিলেন এই রূপসীকে।
ঈসা হাশেমী তার স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসতেন। আর অনিন্দ্য সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন।
একদা এক জোৎস্না রাতে স্ত্রীর সাথে খোশ-গল্প করছিলেন তিনি। এসময় তার চোখের সামনে দুটি সৌন্দর্য খেলা করছিল।
একটি হলো চাঁদের অনুপম সৌন্দর্য আর আরেকটি হলো নজরকাড়া স্ত্রীর দৈহিক সৌন্দর্য। এই দুই সৌন্দর্য একত্রে অবলোকন করে তিনি অভিভূত হলেন। আপ্লুত হলেন। সেই সাথে তুলনা করে দেখলেন–চাঁদের সুন্দরের চেয়ে তার স্ত্রীই বেশি সুন্দরি।
তাই তিনি স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ ও তাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে হাসতে হাসতে বললেন–“তুমি চাঁদের চেয়েও বেশি সুন্দরি।; যদি তুমি চাঁদের চেয়েও অধিক সুন্দরি না হও তাহলে তুমি তিন তালাক।
মানুষ অনেক সময় ঠাট্টাচ্ছলে কিংবা আনন্দের আতিশয্যে এমন কথা বলে ফেলে কিংবা এমন কাজ করে ফেলে, যার কারণে পরবর্তীতে তাকে নানাবিধ ঝামেলা পোহাতে হয়, পেরেশান হতে হয়, লজ্জা পেতে হয়, বিব্রতবোধ করতে হয়, এমনকি কোনো কোনো সময় এমন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, যা পূরণ করা ইহ-জনমেও আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই হাসি-তামাশার সময়ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং চিন্তা-ভাবনা করে কথাবার্তা বলা একান্ত প্রয়োজন।
তালাকের বিধান হলো, যে কোনোভাবে হোক–চাই ইচ্ছা করে হোক; চাই হাসি-ঠাট্টা করে হোক–স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেয় তাহলে তা কার্যকর হবে। পরিস্কার “তালাক” শব্দ উচ্চারণ করে সেখানে একথা বলার সুযোগ থাকে না যে, আমি তো তালাক দেওয়ার নিয়তে বলিনি যে, আমি তোমাকে তালাক দিলাম। অনুরূপভাবে তালাক যদি শর্তযুক্ত হয় এবং উক্ত শর্ত পাওয়া যায়, তাতেও তালাক পতিত হয়ে যাবে। যেমন কেউ যদি তার স্ত্রীকে বলে, তুমি যদি আজ গোছল না করো, তাহলে তোমাকে তালাক। স্বামীর এরূপ বলার পর স্ত্রী যদি সেদিন গোসল না করে তাহলে তার উপর এক তালাকে রাজয়ী পতিত হবে। অর্থাৎ এমতাবস্থায় স্ত্রীকে ইদ্দতের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু যদি শর্তযুক্ত তালাকের ক্ষেত্রে তিন তালাকের কথা উল্লেখ করে তাহলে শর্ত পাওয়া গেলে তিন তালাক পতিত হবে, তখন আর স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। [রদ্দুল মোখতার, দ্বিতীয় খণ্ড, ৬৮৭ পৃষ্ঠা।]
তালাকের বিধান এরূপ হওয়ার কারণে ঈসা ইবনে মূসার স্ত্রী স্বামীর সাথে আর একটি কথাও বলল না।
সে উঠে সোজা পর্দার ভেতরে চলে গেল এবং বলল, আমি যদি সত্যিকার অর্থেই চাঁদের চেয়ে বেশি সুন্দরী না হই, তবে তো আমার উপর তিন তালাক পতিত হয়ে গেছে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়টি স্পষ্ট না হবে যে, আমি চাঁদের চেয়ে বেশি সুন্দরি ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনার সাথে পর্দা করেই চলতে থাকব।
স্ত্রীর কথা শুনে ঈসা ইবনে মূসার সম্বিত ফিরে এল। তিনি আফসোস করে বলতে লাগলেন, হায়! আনন্দের আতিশয্যে এ আমি কী বললাম! এখন আমার কী হবে? তবে কী আমার প্রিয়তমাকে আমি হারাতে যাচ্ছি? যদি তাই হয়, তবে কি হবে আমার অবস্থা! তাকে ছাড়া আমি বাঁচব কী করে? তার অনুপস্থিতিতে আমার জীবনের সচল চাকা তো একেবারে অচল হয়ে হয়ে পড়বে! এসব কথা ভাবতে ভাবতে গোটা রাত তার অস্থিরতা ও পেরেশানীর মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলো।
পরদিন ভোর হতে না হতেই তিনি ছুটে গেলেন খলীফা মানসুরের কাছে। খুলে বললেন সব কিছু। খলীফা মানসুর বিষয়টির সুষ্ঠ সমাধানের জন্য তখনই শহরের বড় বড় ফকীহ ও মুফতিগণকে তলব করলেন।
সবাই একত্রিত হয়ার পর আলোচনা শুরু হলো। অবশেষে সবাই একমত হয়ে ফতোয়া দিলেন–স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে। কেননা চাঁদের চেয়ে অধিক সুন্দর হওয়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
উলামায়ে কেরামের এ মোবারক মজলিশে উপস্থিত ছিলেন, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর এক ছাত্র। তিনি চুপ করে বসে রইলেন। একটি কথাও বললেন না। খলীফা মানসুর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি তো কোনো কথা বললেন না। চুপ হয়ে বসে আছেন। তবে কি উক্ত মাসআলায় আপনি ভিন্ন মত পোষণ করেন?
তিনি বললেন, উক্ত মাসআলায় আমি আপনাদের সাথে একমত নই। আমি মনে করি, স্ত্রী তালাক হয়নি। এ বলে প্রমাণস্বরূপ তিনি সূরা ত্বীনের একটি আয়াত তিলাওয়াত করলেন।
আয়াতের তিলাওয়াত শেষ করে তিনি খলীফা মানসুরের মুখপানে তাকালেন এবং বললেন–হে আমীরুল মুমেনীন! উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় আল্লাহ পাক মানুষকে সুন্দরতম আকৃতিতে এবং চমৎকার গঠনে সৃষ্টি করেছেন।
সুতরাং আল্লাহ পাকের দৃষ্টিতে এবং পবিত্র কুরআনের আলোকে মানুষের চেয়ে সুন্দর আর কিছুই নেই, তাই ঈসা ইবনে মূসার স্ত্রীর চেয়ে চাঁদও সুন্দর নয়। অতএব তার উপর তালাক পতিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তার এ বক্তব্য শ্রবণ করে উপস্থিত উলামায়ে কেরাম বিস্মিত হলেন এবং কোনোরূপ দ্বিমত পোষণ না করে তার ফতোয়া মেনে নিলেন।
এদিকে স্ত্রী তালাক না হওয়ার কথা শুনে ঈসা ইবনে মূসার আনন্দ দেখে কে! তিনি একরকম দৌড়েই বাসায় গেলেন এবং স্ত্রীকে একান্ত করে কাছে এনে সবকিছু খুলে বললেন। এমনতাবস্থায় তার স্ত্রীর আনন্দও কী পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে!?
প্রিয় পাঠক! যে কোনো অবস্থায় আমরা আমাদের মুখকে সংযত রাখব, হিসেব করে ভেবে-চিন্তে কথা বল্ব–এ-ই হোক এ ঘটনার মূল শিক্ষা। হে পাক পরওয়ারদিগার! তুমি আমাদের জবানকে হেফাযত করো। বুঝে-শুনে কথা বলার তাওফীক দাও। আমীন। [সহায়তায়ঃ প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৮৮]