কখনো কখনো পুরুষরাও স্তন সমস্যায় ভুগে থাকেন। তা সাধারণ সমস্যা থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হয়ে থাকে। শতকরা ০.৫-১% ক্যান্সার পুরুষ স্তনে হয়ে থাকে। পুরুষ স্তনের সাধারণ বৃদ্ধিকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে Gynaecomastia. এ ছাড়া পুরুষের স্তন প্রদাহ ও স্তন টিউমার হতে পারে।
লিখেছেন অধ্যাপক ডা. খাদেমুল ইসলাম
বয়ঃসন্ধিক্ষণের স্তন বৃদ্ধি
বয়ঃসন্ধিক্ষণে ১৩-১৪ বছর বয়সে ছেলেদের যখন সাবালকত্বপ্রাপ্তি ঘটে অর্থাৎ মাধ্যমিক যৌন বৈশিষ্ট্য (Secondary sex characters) গুলো প্রকাশ পেতে থাকে, তখন একই সময়ে স্তন স্ফীত হতে পারে। পুরুষ হরমোন এর পাশাপাশি স্ত্রী হরমোনের কিছুটা আধিক্যের কারণে স্তন বৃদ্ধি পায়। সাধারণত উভয় স্তনে গুটির মতো চাকা সৃষ্টি হয় এবং চাপ প্রয়োগে ব্যথাও অনুভূত হতে পারে। এটা সাধারণত স্বল্পমেয়াদি অর্থাৎ ছয় মাস থেকে বছরখানেক স্থায়ী হতে পারে।
তারপর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। গ্রামেগঞ্জে অনেক সময় স্তনের এ গুটিকে জোর করে চেপে ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এতে অনেকেই স্তন প্রদাহে আক্রান্ত হন। যেহেতু এটা প্রাকৃতিক স্বল্পমেয়াদি পরিবর্তন কাজেই কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে- এক দিকে মিলিয়ে যায় কিন্তু অন্য দিকে, স্তন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং যথেষ্ট বড় হয়ে কিশোরীর স্তনের আকার ধারণ করে। এই ক্ষেত্রে যদিও কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা হয় না কিন্তু সামাজিক সমস্যা দেখা দেয় এবং মা-বাবা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন।
সাধারণত কোনো হরমোনের অসঙ্গতি পাওয়া যায় না। সমস্যাগ্রস্ত স্তনের স্তনকলাগুলো শরীরে বিদ্যমান স্বাভাবিক স্ত্রী হরমোনের অতিমাত্রায় স্পর্শকাতরতার কারণে স্ফীত হতে থাকে। সাধারণত কোনো ওষুধের চিকিৎসায় ফল পাওয়া যায় না। অস্ত্রোপচার করে স্ফীত স্তন কেটে ফেলাই যৌক্তিক চিকিৎসা।
যদি উভয় স্তন সমভাবে স্ফীত হতে থাকে- তাহলে স্ত্রী হরমোনের তুলনামূলক আধিক্য থাকতে পারে যা রক্তে পুরুষ ও স্ত্রী হরমোনের পরিমাণ নির্ণয় করে শনাক্ত করতে হবে। যদি জনণেন্দ্রীয় ও অন্যান্য পৌরুষালী চরিত্রগুলো স্বাভাবিক থাকে তাহলে পুরুষ হরমোন চিকিৎসা যেমন Dihydro Testosteron কিংবা Donazol চিকিৎসায় সমস্যা দূরীভূত হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহিলা Anti hormone যেমন Tamoxifen প্রয়োগে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
যদি সত্যি সত্যি মহিলা হরমোনের আধিক্য প্রমাণিত হয় এবং জনণেন্দ্রীয় ও পৌরুষালী চরিত্রগুলো স্বাভাবিক অনুমিত না হয়, তাহলে ক্রমোজমার পরীক্ষা করে সত্যিকার পুরুষ না কি পুরুষ মহিলার সংমিশ্রণ (Klienfelter’s syndrome)- তা নির্ণয় করতে হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে, ৯-১০ বছরের নাদুশ-নুদুশ স্বাস্থ্যবান অনেক ছেলেদের স্তন স্ফীতি, অনেকক্ষেত্রে অস্বাভাবিক স্ফীতি হচ্ছে। অতিরিক্ত মেদ জাতীয় খাবার ও শরীরে অস্বাভাবিক মেদ এ সমস্যার জন্য মূলত দায়ী। কেননা চর্বি কোষের মধ্যে পুরুষ হরমোন মহিলা হরমোনে পরিবর্তিত হয়। এবং ওইভাবে সৃষ্ট স্ত্রী হরমোন স্তনের স্ফীতি ঘটায়। এরা স্কুলে সহপাঠীদের Tease-এর শিকার হয়। ফার্মের মুরগির গোশত সম্ভবত কিছুটা হলেও এ সমস্যার জন্য দায়ী; যেহেতু Poultry feed-এ মুরগিকে দ্রুত বড় করার জন্য হরমোন জাতীয় পদার্থমিশ্রিত থাকে। কাজেই চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার ও ব্যায়াম করে অতিরিক্ত মেদ কমানো স্তন স্ফীতি কমানোর অন্যতম উপায়। তা ছাড়া সমস্যাগ্রস্ত ছেলেদের Poultry chicken না খাওয়ানোই শ্রেয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করে স্ফীত স্তন কেটে ফেলতে হয়।
খ. মধ্য বয়সের স্তন স্ফীতি
মধ্য বয়সের পুরুষের এক বা উভয় স্তনে স্ফীতি ঘটতে পারে। কিছু ওষুধ সেবন অন্যতম কারণ। কিছু ক্ষেত্রে কিছু কিছু অসুখের কারণে স্তন স্ফীতি হতে পারে। যেমন- ক্রনিক লিভার ডিজিজ বা লিভার সিরোসিস, কুষ্ঠ রোগ, অণ্ডকোষের টিউমার অন্যতম। উভয় স্তনের স্ফীতি ঘটলে সেবনকৃত ওষুধগুলোর মধ্যে দায়ী ওষুধকে চিহ্নিত করা এবং তা সেবন বন্ধ করা উচিত। তা ছাড়া উল্লিখিত অসুখগুলো নির্ণয়ের জন্য যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং অসুখের চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
এক দিকের স্তন স্ফীতির ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো কারণ প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে টিউমারজনিত সমস্যার কথাও বিবেচনা করতে হবে। টিউমার হলে যথাযথ চিকিৎসা আর সাধারণ স্ফীতি হলে- অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতে হবে।
গ. বৃদ্ধ বয়সের স্তন স্ফীতি
বৃদ্ধ বয়সে সাধারণত দুই কারণে স্তন স্ফীতি হতে পারে। বয়সের কারণে অণ্ডকাষের কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় পুরুষ হরমোনের তুলনামূলক ঘাটতি ও শরীরে বিদ্যমান স্ত্রী হরমোনের উদ্দীপনা সাধারণত উভয় স্তনের বৃদ্ধি ঘটায়। দ্বিতীয় কারণ- Prostate গ্রন্থির ক্যান্সারের জন্য-স্ত্রী হরমোন প্রয়োগে চিকিৎসা। ব্যথাযুক্ত না হলে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না।
তবে একদিকের স্তনে চাকা দেখা দিলে টিউমারের সম্ভাবনা বিবেচনা করতে হবে।
স্তন প্রদাহ পুরুষের কদাচিত সমস্যা। বয়ঃসন্ধিকালে স্তন স্ফীতির সাথে প্রদাহ হতে পারে। অন্য বয়সে প্রদাহ হলে স্বল্প সময়ের মধ্যে স্তনে ফোলা ও ব্যথা সৃষ্টি হয়। বেদনানাশক ও এন্টিবায়োটিক প্রয়োগে সমস্যা দূরীভূত হয়।
পুরুষদের স্তন টিউমার কদাচিত ঘটনা। সাধারণত দুই ধরনের টিউমার হয়- ফাইলয়েড টিউমার ও সত্যিকার স্তন ক্যান্সার।
ফাইলয়েড টিউমারে স্তনে মোটামুটি বেশ বড় আকারের চাকা হয় এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফাইলয়েড টিউমার নির্দোষ কিংবা ক্যান্সার উভয় প্রকারের হতে পারে। এই টিউমার স্তনের ফাইব্রাস টিসু থেকে জন্ম নেয়, স্তন কোষ বা কলা থেকে নয়। ঋঘঅঈ কিংবা ইরড়ঢ়ংু নমুনা পরীক্ষা করে সঠিক রোগ নির্ণয় করতে হয়। সাধারণত অস্ত্রোপচার করে নিপল ও উপরি ভাগের চামড়াসহ স্তন কেটে ফেলাই সঠিক চিকিৎসা। ক্যান্সার টাইপের হলে বগলের লসিকা গ্রন্থিগুলো ফেলে দিতে হয়। এ টিউমারে কেমো কিংবা রেডিওথেরাপি কোনো কাজ করে না।
শতকরা ০.৫-১ শতাংশ স্তন ক্যান্সার পুরুষদের হয়ে থাকে। পুরুষ স্তন ক্যান্সারের জৈবিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মহিলাদের তুলনায় খারাপ। মধ্য ও বৃদ্ধ বয়সের পুরুষেরা বেশি আক্রান্ত হন। স্বল্প স্তন কলার উপস্থিতির কারণে- পুরুষ স্তনের ক্যান্সার অতিদ্রুত স্তনের উপরি ভাগের চামড়া ও বক্ষ পিঞ্জরে প্রসারিত ও বিস্তৃত হয়ে থাকে।
একই কারণে দ্রুত বগলের লসিকাগ্রন্থি ও দূরবর্তী অঙ্গে বিস্তার লাভ হয়। সে কারণে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরুষেরা যখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন- তখন প্রায়ই অসুখটাকে অগ্রবর্তীপর্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়। FNAC ও Biopsy-এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্যান্সারের পর্যায় (Stage) অনুযায়ী চিকিৎসা প্রয়োগ করতে হয়। পুরুষের স্তন ক্যান্সার যেহেতু দ্রুত বিস্তার লাভ করে, সে কারণে মধ্য বয়সী কিংবা বৃদ্ধ বয়সে কেউ স্তনে গোটা অনুভব করলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
লেখক : জেনারেল ও ল্যাপারোস্কপিক সার্জন, ল্যাব এইড হাসপাতাল, ঢাকা।
আরো পড়ুন :
আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় অ্যাসপিরিন
ডা: মিজানুর রহমান কল্লোল
যেহেতু অ্যাসপিরিন শুধু পেইনকিলার বা ব্যথানাশক ওষুধ নয়, এটা প্রদাহবিরোধী ওষুধও বটেÑ তাই বলা হয় এটা আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় ভালো কাজ করে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অস্টিও আর্থ্রাইটিসসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে এনএসএআইডি হলো প্রথম সারির চিকিৎসা, আর এসব ওষুধের মধ্যে অ্যাসপিরিনকেই সচরাচর নির্বাচন করা হয়। অ্যাসপিরিন গ্রহণ করেন এমন আর্থ্রাইটিসের বহু রোগী বলেন, অ্যাসপিরিন সেবনে তাদের অস্থিসন্ধির ব্যথা ও ফোলা কমে গেছে। তা ছাড়া আর্থ্রাইটিসের অন্যান্য ওষুধের তুলনায় অ্যাসপিরিন খুব কমদামি একটি ওষুধ।
কত দিন অ্যাসপিরিন সেবন করবেন
যদিও প্রেসক্রেপশিন ছাড়াই অ্যাসপিরিন পর্যাপ্ত পাওয়া যায়, তবু আপনার উপসর্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য কী পরিমাণ অ্যাসপিরিন গ্রহণ করবেন সেটার ব্যাপারে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নেয়াটা জরুরি। যদি আপনি বেশি পরিমাণ অ্যাসপিরিন গ্রহণ করেন তাহলে অনেক সমস্যায় পড়বেন যেমন- কান ঝিনঝিন করা, শরীরে পানি জমা, এমনকি অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হওয়া। অস্টিও আর্থ্রাইটিসের রোগীদের ব্যথা নিয়ন্ত্রণে কেবল সামান্য পরিমাণ অ্যাসপিরিনের প্রয়োজন হতে পারে, অথবা তাদের আদৌ এনএসএ আইডির প্রয়োজন নাও হতে পারে।
অন্য দিকে, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগীদের অস্থিসন্ধির প্রদাহের উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে বেশি পরিমাণ অ্যাসপিরিন সেবনের প্রয়োজন হয়। চিকিৎসক রোগীকে দৈনিক তিনটা বা চারটা আদর্শ অ্যাসপিরিন আহারের সাথে এবং রাতে শোবার সময় হালকা নাশতার সাথে মোট চারবার গ্রহণ করার পরামর্শ দিতে পারেন। আদর্শ ট্যাবলেটে থাকে ৩২৫ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন। অতিরিক্ত শক্তির অথবা আর্থ্রাইটিসের জন্য ট্যাবলেটে সাধারণত ৫০০ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন থাকে। আপনার জন্য কতটুকু মাত্রা প্রযোজ্য সেটা আপনার চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেবেন।
কোন ধরনের অ্যাসপিরিন গ্রহণ করা ভালো
অ্যাসপিরিন কয়েক ধরনের পাওয়া যায়। বাফারড এবং এনটারিক কোটেড- এগুলো গ্রহণের অনেক সুবিধা রয়েছে এবং এসব ধরনের জন্য বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব কম ঘটে যেমন পাকস্থলীর সমস্যা ও আলসার। যেসব রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের রোগী অধিকমাত্রায় অ্যাসপিরিন গ্রহণ করেন তাদের এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি ঘটে।
বাফারড অ্যাসপিরিনে থাকে অ্যান্টাসিডের মতো উপাদান যা পাকস্থলীর জ্বালাপোড়া ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে কমিয়ে দেয়। বিশেষ প্রলেপ যুক্ত (যাকে বলে এন্টারিক কোটেড) অ্যাসপিরিন দ্রবীভূত হয় কেবল সেটা যখন ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করে, তাই বিশেষ প্রলেপ অ্যাসপিরিনির সরাসরি সংস্পর্শ থেকে আপনার পাকস্থলীকে রক্ষা করে। সল্যুবল (অথবা ডিসপারসিবল) অ্যাসপিরিন হলো সাইট্রিক অ্যাসিড ও ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (চক) সহ অ্যাসপিরিনের মিশ্রণ। পানিতে সাইট্রিক অ্যাসিড চকের সাথে ক্রিয়া করে ক্যালসিয়ামসাইট্রেট তৈরি করে, এবং এটা অ্যাসপিরিনকে দ্রবীভূত করে বা গলিয়ে দেয়। অ্যাসপিরিনের এসব কোনো ধরনই মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয় না। অ্যাসপিরিনের সব ধরন বাজারে পাওয়া যায়। এন্টারিক কোটেড অ্যাসপিরিনের দাম তুলনামূলক কম। তা ছাড়া এটি পাকস্থলীকে কম উত্তেজিত করে। আর হ্যাঁ, একটি কথা মনে রাখবেন- বোতলের অ্যাসপিরিন সর্বদা শুষ্ক ও ঠাণ্ডা স্থানে রাখবেন- কখনোই আপনার বাথরুমে রাখবেন না!
পুরনো ফর্মুলার অ্যাসপিরিন পরিহার করবেন। এটি শক্ত, অদ্রবনীয় ট্যাবলেট- যা সহজে ভাঙে না। এটি আপনার পাকস্থলীর আবরণকে খুব উত্তেজিত ও ধ্বংস করতে পারে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিঃ, ২, ইংলিশ রোড, ঢাকা। ফোন: ০১৭১৬২৮৮৮৫৫