শীতের রাত। মাঝারি সাইজের বেডরুমটায় ভিন্ন পরিবেশ। রুমের দুই কোনায় দুটি চমত্কার ল্যাম্পশেড। আলো-আঁধারির এক মায়াবী পরিবেশ। রুম হিটারটা উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
মিউজিক চলছে অল্প ভলিউমে। রুমের আরেক কোনে এক গুচ্ছ সুগন্ধি ফুলে ঘরের শোভা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। মাতাল করা সুগন্ধিতে মাস্টারবেডটা রোমান্টিক হয়ে উঠেছে।
রুমের ঠিক মাঝখানটায় একটি হাতলওয়ালা চেয়ার। তাতে বসা এক নগ্ন পুরুষ। পাশেই দাঁড়ানো তার সঙ্গিনী। শারীরিক সম্পর্ক গড়তে তারা প্রস্তুত। মেয়েটি পুরুষটির দুই হাত চেয়ারের হাতলে বেঁধে ফেলল। পা দুটিও বাঁধল চেয়ারের পায়ের সঙ্গে।
‘এই বাঁধনটা একটু ঢিলা করো। লাগছে তো’-বলছিল পুরুষটি। ‘আরে এই তো, আর বেশিক্ষণ কষ্ট করতে হবে না। ঢিলা হয়ে যাবে হাত-পায়ের বাঁধন। এবার চোখ বন্ধ করো তো? আর কোনো কথা হবে না’-মেয়েটি বলছিল কানের সামনে মুখ নিয়ে। পুরুষটির চোখ বেঁধে দিল একটি কালো কাপড়ে। আস্ত এক বোতল লোশন নিয়ে পুরুষটির ওপর ঢেলে দিল মেয়েটি। দুজনেই হাসলো।
শ্বাস-প্রশ্বাস বাড়ে। হঠাৎ মেয়েটির সারা শব্দ নেই। ‘কোথায় তুমি?’ পুরুষটি জানতে চায়। মেয়েটির জবাব, ‘আহা, এই তো আমি। দাঁড়াও! আমি তো আছিই। তোমাকে আজ কোথায় নিব, তুমি নিজেও জানো না।’ এ কথা বলতে বলতে পুরুষটির সামনে এসে ঘেঁষে দাঁড়ায় মেয়েটি। ‘কোথায় আসো’-পুরুষটি ডাকছে তার সঙ্গিনীকে। আর কিছু বলতে পারেননি তিনি।
কারণ মেয়েটির হাতে থাকা ধারালো ছোরাটি এক ঘাঁয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বুকের বাম দিকে। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে পুরুষটি। মেয়েটি তখন প্রায় উন্মাদ। মুহূর্তেই তার চেহারার পরিবর্তন। চোখ দুটি থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছিল। বুকে বিঁধে থাকা ছোরা বেড় করে আবারও বসাচ্ছে। যেন মিউজিকের তালে তালে মেয়েটি রক্তের হোলি উৎসবে মেতে উঠেছে।
বুকে, গলায় বারবার, অসংখ্যবার। গলগলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। কখনো ফিনকির মতো। সেই রক্তে লাল হয়ে গেছে মেয়েটির চেহারা, হাত ও শরীর। চেয়ারের ওপরই নেতিয়ে পড়েছে হাত-পা-চোখ বাঁধা রক্তে রঞ্জিত পুরুষটি। শুধু গোঁ গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে। মেয়েটি যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। হাত দিয়ে মুখে লাগা উষ্ণ রক্ত মোছার চেষ্টা করছে।
এরপর চেয়ারে নেতিয়ে থাকা পুরুষটির গলায় চালিয়ে দিল সেই ধারালো ছোরাটি। নিশ্চিত হলো পুরুষটির প্রাণ ভ্রোমরা বেরিয়ে গেছে। শান্ত হলো মেয়েটি। ওয়াশ রুমে গেল। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকল বেশ কিছু সময়। পরিষ্কার হয়ে কাপড় পরে নিল।
এটি কোনো হরর মুভির কোনো ক্লিপ নয়। একদম সত্য ঘটনা। ঠিক এভাবেই রাজধানী ঢাকার কাফরুলে খুনের শিকার হন একটি প্রাইভেট কোম্পানির অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিকুজ্জামান ওরফে বাচ্চু। আর ঘাতক তারই প্রেমিকা ফাহরিনা ওরফে মিষ্টি। গোয়েন্দাদের কাছে গ্রেফতারের পর ঠিক এভাবেই খুনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন মিষ্টি।
রং নম্বর থেকে প্রথমে ফোনটা আসে। পরে একই নম্বর থেকে আরও কয়েকবার ফোন। কথার সূত্র ধরে একপর্যায়ে হয় পরিচয়। বাড়তে থাকে ঘনিষ্ঠতা। সেখান থেকে ভালোলাগা। ভালোবাসা। ভালোবাসা গড়ায় অবৈধ সম্পর্কে।
অবৈধ মেলামেশার দৃশ্য ধারণ হয় মোবাইলে, ল্যাপটপে। এরপরই ভালোবাসার ইতি ঘটিয়ে সম্পর্ক গড়ায় ব্ল্যাকমেইল পর্যায়ে। অতঃপর সম্মান বাঁচাতে ঠাণ্ডা মাথায় খুন। সিনেমাকে হার মানানো এমনই এক গা ছমছম করা সত্যঘটনা বর্ণনা করেছেন চাঞ্চল্যকর বাচ্চু হত্যাকাণ্ডের আসামি ফাহরিনা মিষ্টি।
জেরার মুখে তিনি বলেছেন, বাচ্চুর ব্ল্যাকমেইলিংয়ে তিনি ছিলেন অতিষ্ঠ। তাই ভিন্নভাবে শারীরিক সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, হাত-পা বেঁধে মিলিত হব। আর ঘরের পরিবেশটাও পরিবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু পরিকল্পনা মতে মিলিত হওয়ার আগেই তাকে শেষ করে দিয়েছি।
২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর সরদার রফিকুজ্জামান ওরফে বাচ্চুকে হত্যা করা হয়। তার নিজ বাসা দক্ষিণ কাফরুলের ৪৫৯/১ নম্বর হোল্ডিংয়ের পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটের একটি রুম থেকে হাত-পা বাঁধা ও জবাই করা অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানি ‘সিকিউরেক্স’-এর ব্যবস্থাপক সরদার রফিকুজ্জামান ওরফে বাচ্চুকে (৪০) রাজধানীর কাফরুল থানাধীন ৪৫৯/১ নম্বর বাড়ির পঞ্চমতলার একটি রুম থেকে হাত-পা বাঁধা, জবাই করা অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। চলেছে বছরব্যাপী তদন্ত কার্যক্রম। অবশেষে ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় গোয়েন্দারা অভিযান চালিয়ে রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন মাটির মসজিদ এলাকার একটি বাড়ি থেকে ফাহরিনা ওরফে মিষ্টিকে (৩০) গ্রেফতার করে।
তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় বাচ্চুর সঙ্গে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের দৃশ্য সংবলিত ল্যাপটপ, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত মিষ্টির একটি ওড়না এবং একটি মোবাইল ফোন।
২০০৯ সালে রংনম্বরে মিষ্টির সঙ্গে বাচ্চুর পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম। প্রেম থেকে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক। দুজনই বিবাহিত। তাদের প্রত্যেকের ঘরে একটি করে সন্তান আছে। অবৈধ দৈহিক সম্পর্কের ভিডিও বাচ্চু মোবাইল ফোনে ও ল্যাপটপে ভিডিও করে রাখত। পরবর্তীতে বাচ্চু ডিভিও ইন্টারনেটে প্রকাশ করার ভয় দেখিয়ে মিষ্টির কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করত। মিষ্টি অপারগতা প্রকাশ করলে বাচ্চু ডিভিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে তার সংসার ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিত।
এমন ভয় দেখিয়ে বাচ্চু তার বন্ধুদের সঙ্গেও মিষ্টিকে দৈহিকভাবে মিলিত হতে বাধ্য করেছে। বাচ্চু মিষ্টির কাছ থেকে দেড় ভরি ওজনের স্বর্ণের বালা ও নগদ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য সময় বিভিন্ন অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এমন অবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে মিষ্টি।
শেষ পর্যন্ত মিষ্টি বাচ্চুকে খুন করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মিষ্টি বাচ্চুর সঙ্গে বনানীতে দেখা করেন। এরপর দুজনে সিএনজি করে কাফরুলে বাচ্চুর বাসায় যায়। মিষ্টি তার ইচ্ছেমতো বাচ্চুর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করার প্রস্তাব দেয়। তাতে রাজি হয় বাচ্চু।
এমন প্রলোভনে মিষ্টি বাচ্চুকে চেয়ারে বসিয়ে পা গামছা দিয়ে চেয়ারের পায়ের সঙ্গে বাঁধে। আর হাত দুটি মিষ্টি তার ওড়না দিয়ে চেয়ারের সঙ্গে বাঁধে। বাচ্চুকে চোখ বন্ধ করতে বলে। চোখ বন্ধ করলে পার্সে রাখা ছুরি দিয়ে বাচ্চুকে জবাই করে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বাচ্চুর ঘাড়ে ও বুকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। হাত ধরে ফেললে মিষ্টি কামড় দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয়।
ঘটনার আগের দিন সড়ক দুর্ঘটনায় বাচ্চুর বাম হাত ভেঙে যায়। ফলে বাচ্চুর শরীর ছিল দুর্বল। এটি বাচ্চুকে খুন করার সুযোগ এনে দেয় মিষ্টিকে। মিষ্টি লাশটি রুমে রেখে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত ছুরি, ডিভিও দৃশ্য ধারণ করা বাচ্চুর মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে পালিয়ে যায়। পরে বাচ্চুর মোবাইল ফোন ও ছুরিটি রাস্তায় ফেলে ল্যাপটপ নিয়ে খিলক্ষেতের বাসায় যায়।
গোয়েন্দারা জানায়, বাচ্চুর মোবাইল ফোনগুলোর ভিত্তিতে তদন্ত করেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একপর্যায়ে তার অফিসের র্যাংগস টেলের ফোনটি নিয়ে তদন্ত করে দেখা যায়, ৩০ ডিসেম্বর বাচ্চু নিহতের দিন থেকে বন্ধ রয়েছে। এরপর ওই মোবাইল ফোনের সর্বশেষ কললিস্টের মাধ্যমে ফাহরিনা ওরফে মিষ্টিকে শনাক্ত করা হয়।
খিলগাঁও মাঠির মসজিদ এলাকার মিষ্টির বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত আলামত ও নিহত বাচ্চুর লুট করা ল্যাপটপটি উদ্ধার করা হয়।