একরাম হত্যা বদির হজযাত্রা জোসেফের মুক্তি ও খালেদা জিয়ার আটকে থাকা

মাদকের গডফাদার হিসেবে গোয়েন্দাদের তালিকার এক নম্বরে থাকা সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি ওমরাহ পালনের নামে দেশ ছেড়েছেন। এদিকে ‘নিরপরাধ’ কাউন্সিলর মো. একরামুল হককে গুলি করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। একই সময়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী ও খুনের দায়ে প্রথমে ফাঁসি ও পরে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত তোফায়েল আহমেদ জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পেয়ে বিদেশে গেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোয় জেলখানায় আটকে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ৮ জুন তার কারাবাসের ৪ মাস পূর্ণ হচ্ছে। এ নিয়ে দেশের রাজনীতিতে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের বছর হওয়ায় এসব ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি মাদক নির্মূলের প্রশ্নে দেশবাসীর মত থাকলেও চলমান অভিযান নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে একরাম ‘হত্যা’র পর বিষয়টি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে। নিহতের পরিবারের সংবাদ সম্মেলন ও হত্যা সংশ্লিষ্ট অডিও প্রকাশের পর কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যার বিষয়টি ফের আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। বিষয়টিতে দেশবাসীর মধ্যে ক্ষোভও বিরাজ করছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও
প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
কাউন্সিলর একরাম হত্যা
কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার তিন বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর মো. একরামুল হক। উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতিও তিনি। তাকে বাসা থেকে র‌্যাবের পরিচয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ডেকে নেওয়ার পর ২৬ মে রাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার অভিযোগ মিলেছে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তিনি একজন মাদক কারবারি। তবে তাকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যার অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী আয়েশা বেগম। অভিযোগের পক্ষে নিহত একরামের স্ত্রী এ নিয়ে কথোপকথনের অডিও প্রকাশ করে দিয়েছেন। পরে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় উঠে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অডিও তিনিও শুনেছেন। পুরো ঘটনা ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করবেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এর সঙ্গে জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না। এদিকে র‌্যাব বলেছে, প্রকাশ হওয়া অডিও খতিয়ে দেখছে বাহিনীটির সদর দফতর।
একরামের পরিবার যা বলছেন
বন্দুকযুদ্ধে নয় বরং বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কাউন্সিলর একরামকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার স্ত্রী আয়েশা বেগম। গত ৩১ মে কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলনে বাবা হত্যার বিচার চেয়ে চিৎকার করে কেঁদেছে একরামের দুই মেয়ে নাহিয়ান হক (১১) ও তাহিয়া হক (১৩)। ঘটনার সময়কার ফোনকলের অডিও সাংবাদিকদের শুনিয়েছেন একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম। সেই অডিওতে শোনা যাচ্ছে যে, একরামুল হকের নিহত হওয়ার ঘটনার সময় এবং তার আগমুহূর্তে ঘটনাস্থলে মোবাইল ফোনে তিনবার কল এসেছিল। শেষ ফোন কলটি রিসিভ হলেও ঘটনাস্থল থেকে ফোনটিতে কেউ উত্তর দিচ্ছে না। প্রথমে আয়েশার কিছুটা কথা আছে। কিন্তু পরে ঘটনাস্থল থেকে একটা ভয়াবহ পরিবেশের চিত্র পাওয়া যায় এই অডিওতে। একরামুল হকের স্ত্রী আয়শা বেগম বলেছেন, ঘটনার আগমুহূর্তে তার দুই মেয়ে প্রথমে একরামুল হকের মোবাইল ফোনে কল করে তার সাথে অল্প সময় কথা বলেছিল। এই কথোপকথনে পরিস্থিতি গুরুতর মনে হওয়ায় সাথে সাথে আয়শা বেগম নিজে ফোন করেন। তার ফোন কলটি রিসিভ করা হয়। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনো জবাব পাননি। তিনি গুলি এবং ঘটনাস্থলের সব শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
আয়েশা বলেন, ‘আমার মেয়ে কথা বলেছিল ওর আব্বুর সাথে। তারপর মেয়ে বললো, আম্মু; আব্বু কান্না কান্না গলায় কথা বলছে। তখন আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম। সেখানে আমার হাসবেন্ড বলতেছে, লোকটি নাজিরপাড়ার লোক হবে, আমি না। তারপর র‌্যাব একজন বলতেছে, এটাতো এটা না। আরেকজন র‌্যাব বলতেছে, আপনারা এটা। তারপরে শ্যুট করে দিছে একজন। তারপরে বলছে, ওনাকে শেষ করেছি। এখন বাইকে শ্যুট করো। তখন গাড়িতে শ্যুট করে দিছে ওনারা।’
আয়শা অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে র‌্যাবের স্থানীয় দুজন কর্মকর্তা ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে। স্ত্রী আয়েশার দাবি, একরাম মাদক ব্যবসার মতো ঘৃণিত পেশার সঙ্গে কখনো জড়িত ছিলেন না। বরং ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি।
আয়েশা বলেন, ‘গত ২৬ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে টেকনাফে দায়িত্বরত সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জমি কেনার কথা বলে একরামকে ডেকে নিয়ে যান। কিন্তু রাত ১১টার পরও বাড়ি ফিরে না আসায় স্বামীর মোবাইল নম্বরে কয়েকবার ফোন দিই। প্রতিবারই আমাদের সঙ্গে কেঁদে কেঁদে কথা বলেছেন আমার স্বামী একরাম।’ চোখের পানি মুছতে মুছতে আয়েশা বলেন, ‘সবশেষ রাত ১১টা ৩২ মিনিটে তিনি ফোন রিসিভ করলেও কথা বলেননি। ওই সময় মোবাইলের অপর প্রান্তের সব কথা আমরা শুনতে পেরেছি। আমরা শুনছিলাম কত নির্মম পরিস্থিতি তিনি পার করেছেন। কী নির্দয়ভাবে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার স্বামীর আর্তনাদ এখনো আমার কানে বাজছে।’ এ সময় মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে একরামের দুই কিশোরী মেয়ে। চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘আমার আব্বুকে হত্যা করা হয়েছে। আব্বুকে হত্যার বিচার চাই। আব্বু ছাড়া কে আমাদের স্কুলে নিয়ে যাবে। আমরা কাকে আব্বু বলে ডাকবো।’ এ সময় অসহায় মেয়ে দুটির কান্নায় সংবাদ সম্মেলনের পরিবেশ ভারি হয়ে যায়। প্রায় ১৫ মিনিট বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন উপস্থিত সবাই। আয়েশা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা মাদক নির্মূল অভিযানকে সমর্থন করি। কিন্তু এ অভিযানে যেন আমার স্বামীর মতো নিরাপরাধ কেউ নির্মম হত্যার শিকার না হয়। কোনো নারী যেন অকালে স্বামীহারা না হয়। কোনো সন্তান যেন পিতৃহারা না হয়। মাদক ব্যবসায়ীরা অপকৌশলে মাদকবিরোধী অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে দাবি করে আয়েশা বলেন, আমার স্বামীর নাম একরামুল হক। তার পিতার নাম আব্দুস সত্তার। টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী পাড়া এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু র‌্যাবের পাঠানো বিবৃতিতে যার কথা বলা হয়েছে তিনি একরামুল হক, পিতা মোজাহের মিয়া প্রকাশ আব্দুস সত্তার। সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া তার ঠিকানা। নাম ও ঠিকানা ভুল করে উদ্দেশ্যমূলক ও রহস্যজনকভাবে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে স্বামী হত্যার বিচার চাই আমি।
তবে র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানিয়েছেন, র‌্যাব সদর দফতর এই অডিও খতিয়ে দেখছে।
স্থানীয়রা বলছেন, একরামুল হক তিন বারের নির্বাচিত একজন কাউন্সিল। তিনি প্রতিদিন মোটরসাইকেলে করে মেয়েদের স্কুলে দিয়ে আসতেন আবার আনতেন। তার বসবাসের ঘরটিও পরিপাটি নয়। একতলা ভবন করার জন্য অনেক আগে কাজ শুরু করলেও অর্থের অভাবে তা আর শেষ করা সম্ভব হয়নি। তিনি যদি মাদক ব্যবসায়ী হবেন, তাহলে তার পরিবারে অর্থনৈতিক টানাপড়েন থাকার কথা নয়।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার জানামতে, তার তিনটি- মাদক অধিদপ্তর থেকে যে লিস্ট বানিয়েছে, সেটার ভেতরে তার নাম আছে। সেটাও আমি দেখেছি। আরও একটি সংস্থার লিস্টে তার নাম ছিল। এ সবগুলো নিয়ে তদন্ত হবে। তারপর বলতে পারবো যে, কে দোষী?’
কক্সবাজারের পৌর মেয়র এবং সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান চৌধুরী এই হত্যাকা-ের বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চান। এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে মাদকবিরোধী পুরো অভিযানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ মে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে কাউন্সিলর একরাম নিহত হন। এ সময় ১০ হাজার পিস ইয়াবা, একটি পিস্তল, একটি ওয়ান শ্যুটারগান, ৬ রাউন্ড গুলি, ৫ রাউন্ড গুলির খোসা এবং একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করার দাবি করে র‌্যাব।
‘গডফাদার’ এমপি বদির হজযাত্রা
মাদকবিরোধী অভিযানে যখন তাকে গ্রেফতার করা না করা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছিল তার মাঝেই ওমরাহ পালনের নাম করে দেশ ছেড়েছেন ইয়াবার গডফাদার হিসেবে গোয়েন্দাদের তালিকার শীর্ষে থাকা সরকার দলীয় কক্সবাজারের এমপি আব্দুর রহমান বদি। ৩১ মে মধ্যরাতে একটি বেসরকারি বিমানে হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বদি দেশ ছাড়েন। তার সঙ্গে মেয়ে, মেয়ের জামাই, বন্ধু আকতার কামাল ও মৌলানা নূরীও গেছেন সৌদি আরবে। মাদক বিরোধী অভিযান চলাকালে এমপি বদির হঠাৎ সৌদি আরবে গমনকে ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে। ‘বন্দুকযুদ্ধ’ থেকে বাঁচতেই বদি ওমরাহর কথা বলে দেশ ছেড়ে যে পালিয়েছেন এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সরকার তাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ কীভাবে দিলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ব্যাপকভাবে।
দেশ ছাড়ার আগে এমপি বদি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অভিযানের ভয়ে দেশ ছাড়ার তথ্যটি সম্পূর্ণ অসত্য। নিয়ম অনুযায়ী দেশ ছাড়তে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছি।’ ওমরাহ পালন শেষ ১৭ জুন দেশে ফিরবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সন্দেহভাজন মাদক পাচারকারী হওয়া সত্ত্বেও সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি কী করে ওমরাহ পালনের নামে সৌদি আরব চলে গেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। মাদকের ‘গডফাদারদের’ ছাড় দেয়া হচ্ছে অভিযোগ করে চলমান অভিযান সফল হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি।
এদিকে ‘বদি যে মাদক ব্যবসার গডফাদার তার প্রমাণ কী?’ -এমন প্রশ্ন তুলেছেন ওবায়দুল কাদের। ‘মাদক ব্যবসার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিও ছাড় পাবে না’ বলেও জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদক বিরোধী অভিযানের নামে কথিত বন্দুকযুদ্ধে যাদের হত্যা করা হচ্ছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কি প্রমাণ আছে? গোয়েন্দাদের তালিকায় থাকা সন্দেহভাজন মাদক কারবারিরা যেখানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছেন, সেই তালিকার এক নম্বরে থাকা গডফাদার বদিকে ধরতে কেন প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে? শুধু অভিযোগের কারণে যদি এমপি বদিকে ধরা না যায় তবে একই অভিযোগের ভিত্তিতে এমনকি তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তিদেরকেও কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে গুলি করে হত্যা করা নিয়ে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। তাছাড়া, কেউ অপরাধী হলে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করে বিনাবিচারে হত্যা নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন তুলেছে মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক এক বিবৃতিতে মাদক বিরোধী অভিযানে বিনাবিচারে বন্দুকযুদ্ধের নামে সাধারণ মানুষ যাতে হত্যার শিকার না হয়, সেদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
খুনের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পাওয়ার পর তা নিয়ে সামাজিক নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক ক্ষমতা বা এখতিয়ারবলে ক্ষমা করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা এই দুই মেয়াদে ২০ জনের বেশি মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ছাড়া পেয়েছেন। রাষ্ট্রপতির এই এখতিয়ার কীভাবে প্রয়োগ করা হয়, আর প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কতটা থাকে? এসব প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকদের অনেকে। হত্যা মামলায় জোসেফের বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ- হয়েছিল ২০০৪ সালে। ২০১৫ সালে গিয়ে উচ্চতর আদালত তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। সেই সাজা ক্ষমা করার জন্য তার মা রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছিলেন ২০১৬ সালে। শেষ পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত এই আসামি রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পেয়ে মালয়েশিয়া চলে গেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, নিয়মনীতি মেনেই তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। ‘সে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাকে তার যে শাস্তি ভোগের মেয়াদ প্রায় ২০ বছরের অধিক হয়ে গেছে। এবং তার যাবজ্জীবন ছিল। অর্থদ- ঠিক রেখে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এক বছর কয়েকমাস দুই বছরের কাছাকাছি সময় তাকে মওকুফ করেছেন। তার চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পারমিশন দিয়েছেন।’
এর আগে ২০১৬ সালে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত একজন আসামিকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করেছিলেন। এছাড়া ২০১১ সালে জাতীয় সংসদে একজন সংসদ সদস্যের প্রশ্নে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর একটি পরিসংখ্যান দিয়েছিলেন। তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যুদ- মওকুফ করা হয়েছে। এগুলোর ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনার প্রশ্ন উঠেছিল। কয়েক বছর আগে এই ইস্যু নিয়ে হাইকোর্ট থেকে একটি রায়ও এসেছিল। তাতে বলা হয়, সাজা মওকুফের ক্ষেত্রে কারণ ব্যাখ্যা করা উচিত। এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশও ছিল সেই রায়ে। সেই নীতিমালা এখনো হয়নি বলে জানা গেছে। তবে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংবিধানেই রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে পরিষ্কার বলা আছে এবং সব নিয়ম মেনেই কারও সাজা মওকুফের সিদ্ধান্ত আসে।
সিনিয়র আইনজীবী শাহদ্বীন মালিক বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা প্রয়োগের কারণ যেহেতু ব্যাখ্যা করা হয় না, সেখানে এই অস্বচ্ছতার কারণেই জনমনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।’ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘সাজা মওকুফের সিদ্ধান্ত নিয়ে নানান প্রশ্ন যে উঠে, সেটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই ক্ষমতাগুলো প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও কিন্তু এক ধরনের সুবিবেচনাপ্রসূত হতে হয়। সেটা যদি না হয়, তাহলে কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে সেগুলো দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হয়। সেটি আইনে শাসনের জন্য কোনো সুখ-বার্তা বহন করে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ জনগণের মধ্যেও নানান প্রশ্ন তৈরি করে যে, কেন ক্ষমা করা হলো? কার প্রভাবে ক্ষমা করা হলো? কোন স্বার্থে ক্ষমা করা হলো, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই যে বাড়তি প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হতে হয়, এটি কিন্তু আইনের শাসনের জন্যে এবং বিচার বিভাগের জন্যে খুব একটা সুখকর ব্যাপার নয়।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান হত্যা মামলার আসামি ছিলেন ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ তোফায়েল আহমেদ জোসেফ। নব্বইয়ের দশকে মোহাম্মদপুর এলাকায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জোসেফ। তখন আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপে যোগ দেন তিনি। রাজধানীতে তখন ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপ ও ‘ফাইভ স্টার’ গ্রুপ দাপিয়ে বেড়াত।
গত ২৭ মে তার সাজা মওকুফ করা হয়। ছাড়া পেয়েই গোপনে দেশ ছেড়েছেন তিনি। এর আগে ২০১৬ সালের জুন মাসে জোসেফের মা রেনুজা বেগম ছেলের সাজা মওকুফের জন্য আবেদন করেন। আইন মন্ত্রণালয় সাজা মওকুফের পক্ষে মতামত দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও ইতিবাচক মতামত পাঠানো হয়। এরপর প্রায় দুই বছর বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা শোনা যায়নি। জোসেফ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাকে ক্ষমা করার বিষয়টি জানাজানি হয়।
সূত্রমতে, কোনো জটিল রোগ ছাড়াই ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ৮ মে পর্যন্ত টানা ২০ মাস কারাগারে না থেকে হাসপাতালে ছিলেন জোসেফ।
রাজনৈতিক মামলায় খালেদা জিয়ার আটকে থাকা
দুর্নীতির একটি মামলায় ৫ বছরের দ- দিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি নির্জন কারাগারে পাঠানো হয় সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। দেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম- কোনো নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জরুরি অবস্থা ছাড়া কারাগারে যেতে হয়েছে এবং জেলখানায় ঈদ করতে হচ্ছে।
আদালত সূত্রের তথ্যমতে, যে মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে কারাগারে নেওয়া হয়েছিল, সেই মামলায় হাইকোর্ট, আপিল বিভাগ থেকে জামিন পেয়েছেন অনেক অগে। কিন্তু পরে রাজনৈতিক ৬টি মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। এর মধ্যে কুমিল্লার দুটিতে হাইকোর্ট বিভাগ জামিন দিলেও আপিল বিভাগ সেই জামিন রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে স্থগিত করেছেন। অপর ৪টি মামলায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জামিন করানো সম্ভব হয়নি। ফলে ঈদের আগে বেগম জিয়ার আর মুক্তির সুযোগ নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে নির্জন কারাগারে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। বাম হাতসহ তার শরীরের একাংশ প্রায় অচল হয়ে গেছে বলে বিএনপি নেতা ও তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বয়বৃদ্ধ নারীকে রাজনৈতিক মামলায় এভাবে আটকে রাখায় হতাশ হয়েছেন তার শুভাকাক্সক্ষীরা। সেই সাথে ক্ষুব্ধও তারা। বিএনপি এখন আর আদালতের উপর নির্ভর না করে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কঠোর আন্দোলন দিয়ে রাজপথে নামার হুমকি দিচ্ছে। দলীয় সূত্র বলছে, ঈদুল ফিতরের পর বিএনপি রাজপথে নামবে। এ ক্ষেত্রে তারা আর সরকারকে কোনো ছাড় দিবেন না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা। সেই সাথে জাতীয় ঐক্য গড়ারও তোড়জোড় চলছে। সেটি সফল হলে গণতন্ত্র মুক্তির দাবিতে জাতীয় ঐক্য আন্দোলনের ব্যানারে রাজপথে দেখা যাবে আওয়ামী বিরোধী ঘরানার সব রাজনৈতিক দলকে। তবে সেই প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সময়ই সব বলে দেবে।
নজর রাখছে জাতিসংঘ
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক দফতর ইউএনওডিসি এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। বাংলাদেশে মাদক বিরোধী অভিযানে বহু মৃত্যুর ঘটনায় গণমাধ্যম এবং সিভিল সোসাইটির তরফ থেকে বিভিন্ন অনুসন্ধানের জবাবে তারা এই বিবৃতি প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছে ইউএনওডিসি। সেই সাথে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়াকে কারাগারে আটকে রাখায় জাতিসংঘ মহাসচিবের ডেপুটি মুখপাত্র উদ্বেগের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর তারা সতর্ক দৃষ্টি রাখছে বলেও নিয়মিত এক ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে।

সুত্র:শীর্ষনিউজ