লাইলাতুল কদর শান্তিময় এক রজনী। আল্লাহ পাক এ রজনীকে শান্তিময় হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এ রজনীতে শান্তির শীতল হাওয়া বিরাজ করে বিশ্বব্যাপী। সূর্য উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শান্তির এ ধারা অব্যাহত থাকে। এ রাতে হজরত জিবরাইল (আ.) অসংখ্য ফেরেশতাসহ পৃথিবী নামক গ্রহে আসেন। শান্তির সবুজ পতাকা বাইতুল্লাহ শরিফের ছাদে উড়িয়ে দেন এবং তাঁর রহমতের পাখা দিয়ে পৃথিবীবাসীকে ঢেকে ফেলেন। এ রাতে ইবাদতরত মানুষজনের সঙ্গে ফেরেশতারা মুসাফাহা করতে থাকেন। ফেরেশতারা যাদের সঙ্গে মুসাফাহা করেন তাদের দিল শান্তিময় হয় এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
রাসূল (সা.) বলেন, এ রাতটি আনন্দময় ও শান্তিময় হবে। বেশি ঠাণ্ডাও হবে না আবার বেশি গরমও হবে না। তিনি আরও বলেন, এ রাতের পরেরদিন সূর্য দুপুর পর্যন্ত কোনো আলো দিবে না। অর্থাৎ শান্তির বাতাস পরদিন দুপুর পর্যন্ত প্রবাহিত হবে।
বিজ্ঞান নিয়ে গবেসনাকারী প্রতিষ্ঠান NASA-এর বরাত দিয়ে হাফিংটন পোষ্টে প্রকাশিত Laylat Al Qadr ! What Is The ‘Night Of Power?’ শিরোনামে এক সমীক্ষাধর্মী সংবাদের বরাত দিয়ে মুফতি কাজী ইবরাহিম দিয়ে বলেন- ‘ ‘আমেরিকান মহাকাশ বিজ্ঞানী NASA-এর গবেষকরা গবেষণা করে দেখেছেন আকাশ থেকে প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ২০ লাখ স্তে বা উল্কা পৃথিবীতে পড়ে। বিভিন্ন কারণে উল্কা পড়ে।
এর মধ্যে একটি বড় কারণ হল- ভূগর্ভে লোহার ঘাটতি হলে ওই স্তে বা উল্কাপিণ্ড দিয়ে তা পূরণ করা হয়। কিন্তু বছরে একটি রাতে কোনো স্তে বা উল্কা আকাশ থেকে পড়ে না। নাসার বিজ্ঞানীরা মিলিয়ে দেখেছেন এ রাতটি কদরের রাত।’ রাসূল (সা.) বলেছেন- এ রাতে আকাশ থেকে কোনো উল্কা ছুটে না।
সুতরাং আল্লাহ পাক যে বলেছেন, এ রাতটি শান্তিময় হবে তা আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। ইসলাম হল বিজ্ঞানভিত্তিক একটি আধুনিক ধর্মের নাম। রব কর্তৃক সর্বশেষ ধর্ম এবং রবের সর্বশেষ সিলেবাস অনুযায়ী এ ধর্ম পরিচালিত হয়।
কেন এ রাত এত শান্তিময়? কী ঘটেছে এ রাতে যে, এত শান্তিময় হবে? নিশ্চয়ই এ রাতে এমন কিছু Download বা Install করা হয়েছে, যার ফলে এ রাত শান্তিময় হয়েছে। কী Download বা Install করা হয়েছে? আল্লাহ পাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এ মহাগ্রন্থ এক শান্তিময় রজনীতে নাজিল করেছি।’ লাইলাতুল কদর শান্তিময় হওয়ার মূল কারণ এ রাতে কোরআন নাজিল হয়েছে।
মহাগ্রন্থ আল কোরআনের কারণেই এ রাতকে শান্তিময় করা হয়েছে। তা হলে কোরআন হল শান্তির মূল আধার। আজও যদি বিশ্বব্যাপী কোরআন প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে গোটা বিশ্ব শান্তিময় হবে। অতীতে এ রকম বহু নজির আছে। রাসূল (সা.) ও সাহাবীরা সে সমাজ প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ববাসীকে তা দেখিয়ে গেছেন। ভবিষ্যতেও বিশ্ববাসী কোরআনের সেই শান্তিময় বিশ্ব দেখবে ইনশা আল্লাহ।
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে ইমাম মাহদী ও ঈশা (আ.) এসে কোরআন প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ববাসীকে শান্তিময় বিশ্ব উপহার দিবেন। যেখানে সিংহ আর উট একসঙ্গে বসবাস করবে, উটকে আক্রমণ করার কোনো সাহস সিংহ পাবে না। চিতাবাঘ গরুর সঙ্গে একই মাঠে চড়ে বেড়াবে, কিন্তু গরুকে আক্রমণ করার কোনো ক্ষমতা চিতাবাঘের থাকবে না। নেকড়েবাঘ ছাগল-ভেড়ার সঙ্গে গলাগলি করবে কিন্তু আক্রমণ করবে না। মানবশিশু বিষধর সাপ নিয়ে খেলা করবে কিন্তু সাপ ছোবল মারবে না।’ কেননা তখন শান্তিময় বিশ্ব প্রতিষ্ঠা হবে। সর্বত্র শুধু শান্তি আর শান্তি বিরাজ করবে।
এ রাতেই শান্তির বাণী কোরআনুল কারিম পৃথিবীতে এসেছে। কোরআন নাজিলের এ রাতকে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আরবি ভাষায় হাজার শব্দটি সংখ্যাধিক্য বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। হাজার দিয়ে কয়েক হাজারও বুঝানো হতে পারে। আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। তবে রাতটি যে খুবই শান্তিময় ও পুণ্যময় এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
এ রাত পৃথিবীবাসীর জন্য যেমন শান্তিময় তেমনি কবরবাসীর জন্যও শান্তিময়। যে ব্যক্তি দুনিয়ায় এ রাত ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটিয়েছে সে ব্যক্তি কবরে শান্তি পাবে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের কবরকে শান্তিময় পেতে চাইলে লাইলাতুল কদরে সারা রাত ইবাদত কর।’
কদরের সবটা রাতই আল্লাহ পাক সুন্দর ও মোহনীয় করেছেন। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের উচিত এই মোহনীয় রাতে বেশি বেশি তাসবিহ-তাহলিল ও ইবাদত-বন্দেগী করা। কোনো ব্যক্তি যদি পূর্ণ ঈমান নিয়ে গুনাহ মাফের আশায় এ রাত তাসবিহ-তাহলিল ও ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে যাপন করে, আল্লাহ পাক তার পূর্বের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ পাক এ রাতে বান্দাদের ডাকতে থাকেন, কেউ আছ আমার কাছে রিজিক চাইবার, আমি রিজিক দিব। কেউ আছ আমার কাছে মাফ চাইবার, আমি মাফ করে দিব। কেউ আছ আমার কাছে রোগমুক্তি চাইবার, আমি রোগমুক্তি দিব। এভাবে আল্লাহ পাক সকাল পর্যন্ত তাঁর বান্দাদের ডাকতে থাকেন। আল্লাহ পাক এ রাতে সব বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন।
সে জন্য আমাদের গুনাহ মাফের এ সুযোগ কাজে লাগান উচিত। যে ব্যক্তি গুনাহ মাফের এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি, সে ব্যক্তি সত্যিই হতভাগ্য। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, সে সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে। একমাত্র হতভাগ্য বা বঞ্চিত ব্যক্তিরাই এ রাতের সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।’
রাসূল (সা.) ও তাঁর পরিবার-পরিজন যেন এ রাত থেকে কোনোভাবেই মাহরুম বা বঞ্চিত না হন, সে জন্য তাঁর পরিবার পরিজন নিয়ে মসজিদে ইতিকাফ করতেন। রাসূল (সা.) তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফকারী সহজেই এ রাত পেতে পারেন।
এ রাতে যে কোনো দোয়া আল্লাহ পাকের কাছে করা যায়। যে কোনো বৈধ জিনিস আল্লাহ পাকের কাছে চাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে ভালো হল সে দোয়াটি করা, যে দোয়াটি রাসূল (সা.) হজরত আয়েশা (রা.)কে শিখিয়েছিলেন। যেমন বর্ণিত আছে। হজরত আয়েশা (রা.) একবার রাসূল (সা.)কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই, তাহলে আমি কী করব? তিনি বলেছিলেন, তুমি বলবে, হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাকারী। আপনি ক্ষমাকে ভালোবাসেন। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।’ এ রাতে কারো নামে যদি ক্ষমা লেখা হয়, তাহলে তার জীবন ধন্য।