তসলিমা নাসরিনের সেক্সবয়

চৈতালী অপেক্ষা করছে সেক্সবয়ের জন্য। সন্ধেও নামবে, সেক্সবয়ও নামবে কলকাতায়। অন্ধকারের হাতে হাত ধরে দক্ষিণ কলকাতার এই গলিতে ঢুকবে বিমান বন্দর থেকে আসা সেক্সবয়ের ট্যাক্সি। বোম্বে থেকে আসছে সে। চৈতালীর বাড়িতেই উঠবে। দু’জনের গত ছ’মাস যাবৎ প্রায় সব হয়েছে, শুধু সামনাসামনি দেখাটাই হয়নি। ফেসবুকে প্রথম কথা হয়, মূলত সেক্সের কথা। চৈতালীকে আকৃষ্ট করেছিল সেক্সবয় নামটি। প্রোফাইলের ছবিটি উলঙ্গ পুরুষের। এর সঙ্গে সেক্স ছাড়া আর কী বিষয়ে কথা বলা যায়! সেক্স নিয়ে কথা বলার জন্যই সেক্সবয়কে বন্ধু হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল চৈতালী। নিজের যৌনসম্পর্কহীন জীবন বড় দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। শহরে এত যুবকের ভিড়, আর চৈতালীর মতো সুন্দরী বিদুষী মেয়ের জন্য কোনও প্রেমিক জোটেনা! জুটবেই বা কী করে, জুটতে হলে যা যা করতে হয়, চৈতালী তার প্রায় কিছুই করে না। শহরটাকে আজকাল সয় না চৈতালীর। পার্টিতে যাওয়ার আমন্ত্রণ আসে, কিন্তু যায় না সে। ওই এক মুখগুলোর মুখোমুখি হওয়া, ওদের একই গল্প দু’শ বার শোনা, ঠোঁটে নকল হাসি ঝুলিয়ে সকলকে হাই হ্যালো বলা–অনেক হয়েছে, আজকাল আর ভালো লাগে না। তার চেয়ে সোশাল নেটওয়ার্কে নতুন মুখের সন্ধান পাওয়া যায়, নতুন কথাও শোনা যায়। যে লোকটির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল চৈতালীর, সেটিও হয়েছিল বাবার ঠিক করে দেওয়া পাত্রর সঙ্গে। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে সুব্রতকে ডিভোর্স করেছে চৈতালী। এরপর একেবারেই যে কারও সঙ্গে কিছুই ঘটেনি তা নয়। বয়সে দশ বছরের ছোট এক সহকর্মীর সঙ্গে প্রায় একমাস-মতো একটা সম্পর্ক ছিল চৈতালীর। কিন্তু ওর, ওই সহকর্মীর, অশোকের, বিয়ের পর ওই সম্পর্কটা ভেঙে ফেলতে বাধ্য হয় সে। চৈতালী চায়নি ঘরে তরুণী স্ত্রী রেখে তার সঙ্গে গোপনে শুতে আসুক অশোক। একটি ইংরেজি দৈনিকে চাকরি করে চৈতালী। অনেকদিনের চাকরি। অনেক দায়িত্ব। কিন্তু কোনও অফিসের কোনও বোঝা চৈতালী বাড়ি বয়ে আনতে চায় না। বাড়িতে থাকতে চায় সে নির্ভাবনাহীন। সামান্য কিছুক্ষণ সময় নিজের জন্য রাখতেই তো হয়, কিছুক্ষণই তো সময়! ওদিকে মেয়ে পড়ছে দিল্লিতে। ওর খোঁজ খবরও করতে হয়। আজকাল মোবাইল যুগে খোঁজ খবরের ব্যাপারগুলো জলের মতো সোজা। অফিস তো অফিস, চৈতালী না থাকলেও অফিস থাকবে। মেয়ের জীবনও মেয়ের জীবন। চৈতালী মরে গেলেও মেয়ে দিব্যি মানিয়ে নেবে। চৈতালীর বাবা-মা মারা গেছেন। চৈতালীই ছিল একমাত্র সন্তান। মা বাবার কথা তার এখন খুব মনেও পড়ে না। অফিস থেকে ফিরে আগে একটা বই নিয়ে বসতো, এখন ফেসবুক নিয়ে বসে। ফেসবুক যে কী ভয়ংকর এক নেশার মতো! আসলে, ফেসবুক নয়, সেক্সবয় প্রতিদিন যে বলছে চৈতালীর সঙ্গে বিছানায় সে কী কী করবে, কী করে চৈতালীর সারা শরীরে চুমু খাবে, কী করে ঠোঁটে, বুকে আদর করবে, কী করে চৈতালীর স্বাদ নেবে, আর তাকে ঘনঘন শীর্ষসুখ দেবে — সেসব পড়ার নেশা। এই নেশাটা তাকে প্রচুর অস্থিরতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এখন সে রাস্তাঘাটের বা অফিসের যুবকগুলোর দিকে আগের মতো অত চাই চাই চোখে তাকায় না। সেক্সবয় চৈতালীর দৈনন্দিন জীবনের অভাবগুলো অনেকটাই দূর করেছে। মনে মনে সে কৃতজ্ঞ সেক্সবয়ের কাছে। ফেসবুকেই সম্পর্কটা এখন আটকে নেই। দু’মাস যাবৎ প্রায় প্রতিদিন কথা হচ্ছে ফোনে, আর শেষ কয়েকদিন স্কাইপতে দু’জনের সেক্সও ঘটেছে। ভারচুয়াল সেক্স। সেক্সবয়ের আসল নাম বিজয়, মারাঠী, আর্কিটেক্ট, বয়স পয়ত্রিশ। এর চেয়ে চমৎকার আর কোন জুটি! চৈতালীর সঙ্গে সত্যিকার সেক্সের প্রস্তাবটি চৈতালীই দিয়েছিল বিজয়কে। বোম্বে-কলকাতা আসা যাওয়ার ইটিকিটও ‌ ইমেইল করেছিল। টিকিট পেয়ে ‘লেটস ফাক হোল উইক’ বলে লাফিয়ে উঠেছিল বিজয়। বিজয়কে ছুঁয়ে দেখতে চায় চৈতালী। সত্যিকার মৈথুন চাই, রক্ত মাংসের শরীর চাই, হস্তমৈথুন শরীর আর নিতে চাইছে না।

সাতদিনের ছুটি নিয়েছে চৈতালী, আজ বিকেলেই অশোক জিজ্ঞেস করেছে, ‘হঠাৎ এতদিনের ছুটি কেন? কোথাও যাচ্ছো?’ চৈতালী হেসে বলেছে, ‘ক্লাউড নাইন’এ যাওয়ার ফ্লাইট বুক করেছি। যাবি?’ ‘বিয়েটা না করলে ঠিক ঠিকই যেতাম’। চৈতালীর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। মনে মনে বলে ‘ভাগ্যিস বিয়েটা করেছিলে’। অশোকের জন্য সেই আকর্ষণ আর বোধ করে না চৈতালী, বিজয় এসে অশোকের জায়গা, চৈতালী জানেনা, কবেই দখল করে নিয়েছে। অশোকের বিয়ের পর বিজয়ের মতো একজন পুরুষেরই দরকার ছিল তার জীবনে, এরকম বানের জলের মতো কেউ, পুরোনো সব স্মৃতি খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নেবে, স্নিগ্ধ শীতল নতুনতা ছড়িয়ে তাকে আরও উজ্জ্বল করবে, যেন সে জন্ম নিল এইমাত্র, অতীত বলে কিছু ছিল না কখনও তার। অশোক অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছে, ‘কী কারও প্রেমে পড়েছো নাকি, দেখতে আরও উজ্জ্বল হয়েছো’। মিষ্টি হেসে চৈতালী বলেছে, ‘এই, মুনা কেমন আছে? চলছে তো সব ঠিকঠাক’? বলে, অশোকের উত্তরের জন্য না অপেক্ষা করেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে চৈতালী। প্রতিদিন যখন বেরোয় তার চেয়ে খানিক আগেই বেরিয়েছে। শরীর জুড়ে বিজয় তার। সকাল থেকেই শরীরে জোয়ার।

বাড়িতে এসে গান গাইতে গাইতে স্নান করেছে। এত সময় নিয়ে স্নান সে করেনা খুব। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সেজেছে। পারফিউম মেখেছে। শোবার ঘরটা সাজিয়েছে। নতুন চাদর বিছিয়েছে বিছানায়। দুটো শুধু বালিশ ছিল, নতুন দুটো বালিশ যোগ করেছে। পুরোনো বনেদি বাড়ি চৈতালীর। নিচের তলায় বসার ঘর, খাবার ঘর, রান্নাঘর, ওপর তলায় চারটে শোবার ঘর। একটায় অপ্রয়োজনীয় অথবা কখনও প্রয়োজন হবে বা হতে পারে এমন জিনিস পত্রে ঠাসা। একটায় চৈতালী থাকে। আরেকটা অতিথির জন্য। আরেকটায় থাকে শকুন্তলা। শকুন্তলা পুরোনো কাজের লোক। জন্ম থেকেই এখানে আছে, একসময় তার মা কাজ করতো এ বাড়িতে। শকুন্তলা জিজ্ঞেস করেছে, ‘আজ অশোকবাবু আসছে নাকি চৈতি, এত সাজগোজ করছো যে?’ শুনে বিরক্ত কণ্ঠে চৈতালী বলেছে, ‘তুমি যে দিদি কী আবোল তাবোল বকো, অশোক বউ নিয়ে সুখের সংসার করছে, ও আসবে কেন?’
‘তাহলে, নতুন ভাগ্যবানটা কে শুনি?’
চৈতালী হেসে বলেছে, ‘এলেই দেখতে পাবে’।
শকুন্তলা প্রচুর রান্না করেছে আজ। বিজয় আর চৈতালী ক্যাণ্ডেল-লাইট ডিনার করবে। তারপর শোবার ঘরে চলে যাবে, দরজা বন্ধ করে দেবে ঘরের। জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। বিছানা থেকেই আকাশ আলো করা চাঁদটা দেখতে পাবে। জোৎস্নায় ঘর ভরে যাবে, আর ওই আলোয় তারা শরীরে শরীর ডুবিয়ে স্নান করবে সারারাত। শোবার ঘরটায় চৈতালী জুঁই এর সুঘ্রাণ ছড়িয়ে রাখে। নিজের গায়েও সুগন্ধী। বাড়িটায় যেন ফুলের উৎসব হচ্ছে। কণিকার রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দেয়। ‘হৃদয়বাসনা পূর্ণ হলো’ গানটি বাজতে থাকে। চৈতালী গাইতে থাকে কণিকার সঙ্গে। কখনই খুব ভালো গাইতে জানে না চৈতালী, কিন্তু কণিকার গানগুলো বড় হৃদয় দিয়ে গায়। হৃদয় দিয়ে গাওয়া গান, গানের গলায় না গাইলেও, অত সুরেলা গলা না হলেও, বেশ ভালো শোনায়।

চৈতালী একটা নীল রঙের শাড়ি পরেছে। ইচ্ছে করেই খুব বড় গলার ব্লাউজ পরেছে। স্তনজোড়া উঁকি দিচ্ছে, দিক। লরিয়েলের কালো রং চৈতালীর চুলে। সামান্যই পেকেছে যদিও, চৈতালী মুছে ফেলেছে সাদার চিহ্ন। চল্লিশের টান টান শরীর, কিন্তু চুলে বার্ধক্য, ঠিক মেলে না। এমনিতে কালো সাদায় তার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু সেক্সবয়ের সঙ্গে সাতটা দিন ঘনিষ্ঠ সময় কাটাবে, বয়সের চিহ্ন এসে না হয় এই সাতটা দিন না বিরক্ত করুক।

বিজয় ফোন করেছে দমদমে নেমেই। ব্ল্যাক লেবেলের একটা বোতল আর দুটো গ্লাস এনে শোবার ঘরের খাটের পাশে রাখে চৈতালী। এরকম অ্যাডভেঞ্চার আগে কখনও করেনি সে। এরকম উত্তেজনাও আগে সে বোধ করেনি। একটা অচেনা মানুষের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হলো, তার সঙ্গে যৌনসম্পর্কে যাওয়ার জন্যই সব আয়োজন দু’জন করছে, কোনও প্রেম হলো না, কেউ কারও জন্য ভালোবাসি শব্দটা উচ্চারণ করলো না, যৌনতা ছাড়া জগতের অন্য কোনও বিষয় নিয়ে কোনও আলোচনা হলো না! দুজনের কিন্তু কারওরই মনে হচ্ছে না খুব বিচ্ছিরি কোনও কাজ তারা করছে। দুজনই প্রাপ্ত বয়স্ক। দুজনই একা থাকে। কোনও স্বামী বা কোনও স্ত্রীকে ঠকিয়ে কিছু করছে না তারা, শরীর চাইলে শরীর তারা তবে কেন মেলাবে না!
সকাল থেকেই শরীরে বান ডাকছে। চৈতালীর মনে হতে থাকে সে নিতান্তই ষোলো বছর বয়সী এক কিশোরী। না হয় সে ষোলো বছর বয়সীই। ষোলো বছর যখন বয়স, তখন সে কঠিন কঠিন বই পড়ে কাটিয়েছে, চল্লিশ বা পঞ্চাশ বয়সীরা যা করে। সেই ষোলোটা ফেরত পাওয়ার যদি সুযোগ হয়, তবে ফেরত সে নেবে না কেন! কাউকে তো দিব্যি দেয়নি যে ফেলে আসা কোনও বয়স সে কোনওদিন ফেরত নেবে না।

চৈতালীর কাছে বিজয় সম্ভবত আস্ত একটি পুরুষাঙ্গ ছাড়া আর কিছু নয়। সে বলে কয়েই সাতদিন শুতে আসছে চৈতালীর সঙ্গে। শুধু শরীরের আকর্ষণকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে একটা সম্পর্ক। চৈতালী ভাবে, সবসময় যে আগে মন, পরে শরীর হতে হবে তারই বা কী মানে, শরীর আগে, মন পরে হওয়াটাই বরং বেশি যৌক্তিক। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চয়ই বিজয় ওকে জড়িয়ে ধরে গভীর করে চুমু খাবে। তারপর সোজা শোবার ঘরে। দৃশ্যগুলো কল্পনা করে চৈতালী। আবেগে চোখ বোজে। শরীরে নিভৃতে গর্জন করে সুখের স্রোত। শকুন্তলাকে বলে রেখেছে, ঘরের দরজা বন্ধ করে যেন সে শুয়ে থাকে, দরকার হলে ডাকবে। কেবল খাবার সময় শকুন্তলার ডাক পড়ে। শকুন্তলা জানে নিয়মগুলো। অশোকের সময় এরকমই ঘটতো। চৈতালীর ডিভোর্সের পর শকুন্তলা বলেছে অনেকবার, ‘এবার একটা বিয়ে করো চৈতি’। বিয়ে করবো না করবো না বলে কয়েক বছর পার করেছে। তারপর অশোকের সঙ্গে যখন প্রেম করছে চৈতালী, শকুন্তলা বলেছে, ‘তাহলে একজন বন্ধুকেই পার্মানেন্ট করে নাও’। কাউকে যে ইচ্ছে করলেই কিছু করে নেওয়া যায় না, তা শকুন্তলাকে শত বলেও বোঝাতে পারে না চৈতালী। শকুন্তলা চৈতালীর জন্মের সময় থেকে এই বাড়িতে আছে। বিয়ে করেনি। অথচ চৈতালীর বিয়ে না করা আর স্থায়ী সঙ্গী না নেওয়া নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। নিজের চেয়ে মনিবের পরিবারকে আপন করে দেখলে বুঝি এই হয়।

২.
বিজয় এলো। ফটো দেখে বা স্কাইপেতে দেখে যেমন অনুমান করেছিল, তার চেয়ে অন্যরকম, যতটুকু লম্বা ভেবেছিল, তার চেয়ে বরং খানিকটা বেশি, যতটা মোটা লাগছিল, তার চেয়েও স্লিম, যতটা সুদর্শন ভেবেছিল, তার চেয়েও বেশি সুদর্শন বিজয়। দু’জন হাই বিজয়, হাই চৈতালী বলে হাত মেলালো। শোবার ঘরে নেওয়ার বদলে চৈতালী বসার ঘরে নিয়ে এলো বিজয়কে। দু’সোফায় মুখোমুখি বসলো দুজন। একটুখানি দৃষ্টি বিনিময়। একটুখানি হাসি দুজনের ঠোঁটে। চৈতালী বসে আছে বিজয় উঠে এসে ঠিক স্কাইপেতে যেমন বলতো, ‘ইউ লুক সো হট হানি। কাম অন, লেটস হ্যাভ সেক্স’ বলে কি না। বিজয় নিজেই কাপড় খুলে ফেলতো, ক্যামেরাকে নামিয়ে দিত উরুসন্ধির দিকে, আর চৈতালিও খুলতো বুকের কাপড়। বিজয় সেরকম কিছুই বললো না। বলুক বা না বলুক, দুটো যৌনকাতর নারী পুরুষ আজ মুখোমুখি বসে আছে। দুটো শরীরের কামনা আজ পূর্ণ হতে যাচ্ছে ।
কিন্তু আশ্চর্য, দুজনের কথপোকথনে যৌনতার তিল মাত্র কিছু নেই।
— একটু জল খাবো।
–আই অ্যাম সরি। জল আগেই দেওয়া উচিত ছিল। চা বা কফি কিছু খাবে?
–না। আমি খাইনা ওসব।
–তবে কি, হুইস্কি খাবে?
–হুইস্কি তো আমি খাই-ই না।
–ও।
–ক’টার সময় রাতের খাবার খাও?
–ঠিক নেই। বেশ সুন্দর সাজানো ফ্ল্যাট। এত বই কার? সব তোমার?
–হ্যাঁ আমার।
বিজয় উঠে বইয়ের তাকগুলোর দিকে যায়, মগ্ন হয়ে বই দেখতে থাকে। অনেকক্ষণ কেটে যায় এভাবে। চৈতালী জল এনে দিলে বই দেখতে দেখতেই জল খায়।
–ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড, আমি কি কিছু বই বের করতে পারি এখান থেকে?
–হ্যাঁ নিশ্চয়ই, গো এহেড।
বিজয় তিনটে বই নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। সোফায় এসে বললো, তুমিও দেখছি রডি ডয়েলের বই পছন্দ করো। দ্য ডেড রিপাবলিক পড়েছো?
চৈতালী হেসে বললো, ওর শুধু তিনটে পড়েছি, প্যাডি ক্লার্ক হাহাহা, এ স্টার কল্ড হেনরি আর দ্য গাটস।
–তোমার অসাধারণ কালেকশন।
–ক্লাসিকস বেশ কিছু আছে।
–ক্লাসিকসের কথা বাদ দাও। ওগুলো ছোটবেলায় পড়েছি। ইদানীং বিল ব্রাইসন থাকলে আমার আর কিচ্ছু চাই না।
–আছে বিল ব্রাইসন বেশ কটা।
চোখে মুখে খুশি লাফায় বিজয়ের।
–তুমি বিল ব্রাইসনও পছন্দ করো? বাহ! কোনগুলো আছে বলো না। শেষটা এখনও পড়িনি।
–আমার সবচেয়ে পছন্দ এ সর্ট হিস্টরি অব নিয়ারলি এভরিথিঙ্।
–ও বইটার তুলনা হয় না।
–আমার কাছে আছে আই অ্যাম এ স্ট্রেঞ্জার হেয়ার মাইসেল্ফ, অ্যট হোম, নাইদার হেয়ার নর দেয়ার..
–ওয়ান সামারটা তো এখনও বেরোয়নি বোধহয়।
–এই অক্টোবরে বেরোবে।
বিজয়ের মধ্যে একটা কিশোর বাস করে। দেখে ভালো লাগে চৈতালীর। চৈতালীর মতোই সে উজ্জ্বল উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে সময় সময়। বইয়ের গল্পে মেতে ওঠে বিজয়। যেন দুজনে কোনও বুক ক্লাবের মেম্বার। বইয়ের পছন্দে এত মিল আর কারও সঙ্গে নেই চৈতালীর। তারপর কথায় কথায় বেড়ানোর কথা উঠলো, ভারতের কোথায় কোথায় কে গেছে। তাতেও মিল, দুজনে বর্ণণা করতে থাকে দু’জনের অভিজ্ঞতা, কোথায় কোন পাহাড়ে, কোন জল প্রপাতের ধারে, কোন জঙ্গলের কোনখানটায় মুগ্ধ দাঁড়িয়েছিল কবে। একসময় খাবারের প্রসঙ্গ ওঠে, ওতেও মিল। দুজনই বাঙালি খাবার পছন্দ করে।
দশটা বেজে যায় গল্প করতে করতে। জল ছাড়া কেউ আর কিছু পান করে না। ফলের রসও, বিজয় বলেছে, খাবে না। শকুন্তলাকে ডাকে চৈতালী। শকুন্তলা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দেয়। না, মোমবাতি জ্বালানোর প্রয়োজন মনে করে না চৈতালী। খেতে খেতে বিজয় বলে, ‘বাহ , বেশ কম তেলে কম মশলায় রান্না তো। আমার মা’র রান্নার মতো।‘ শকুন্তলা ভালো রাঁধে। শকুন্তলার বেশ প্রশংসা করলো বিজয়। চৈতালীর থালায় নিজে খাবার বেড়ে দিল। খাওয়া শেষ হলে রান্নাঘরে গিয়ে নিজের থালা নিজেই ধুয়ে রেখে এলো। পরিপূর্ণ ভদ্রলোক। দেখে বেশ ভালো লাগে চৈতালীর। কলকাতায় আজ অবধি এমন ভদ্রলোক সে দেখেনি। খেয়ে ওঠার পর বিজয় বললো চৈতালীকে কাল ডিনারে নিয়ে যাবে সে, কলকাতার সবচেয়ে ভালো বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্টে। শকুন্তলা জিজ্ঞেস করলো, বিজয়ের মা কী কী রাঁধেন, শুধু মারাঠী রান্না, নাকি বাঙালি রান্নাও? বিজয় অনেক ক্ষণ চুপ হয়ে থেকে বলে যে তার মা মারা গেছেন এক বছর হল। সড়ক দুর্ঘটনায়। বিজয় মায়ের সঙ্গেই থাকতো। বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে দাদা। গাড়িটা সেদিন চালাচ্ছিল বিজয় নিজে। দাদার বাড়ি থেকে রাতের খাবার খেয়ে ফিরছিল বান্দ্রায় নিজের বাড়িতে। মদ্যপান করেছিল। বোমার মতো একটা ট্রাক ছুটে আসছিল তার গাড়ির দিকে, দেখতে পায়নি। ট্রাক এসে ধাক্কা মারলো, আর গাড়িটা গড়াতে গড়াতে খাদে পড়ে গেল। ওখানেই মারা যায় মা। বিজয় চোট পেয়েছিল, তবে হাসপাতালে দুদিন থাকার পর তা সেরে যায়। সেদিনের পর থেকে বিজয় আর মদ ছোঁয়নি। মায়ের কথায় মায়ের কথা আসে। শকুন্তলাও মায়ের গল্পে যোগ দেয়। চৈতালী অনেকদিন ভুলে ছিল নিজের মাকে। আজ যেন মা তার সামনে এসে বসেছে। স্মৃতির ঝাঁপি সকলেই খুলে বসে। স্মৃতির সঙ্গে অনেক দূর কুয়াশায় হাঁটতে হাঁটতে সকলের চোখ ভিজে ওঠে। বিজয় তার মায়ের প্রসঙ্গ না তুললে সম্ভবত চৈতালী ভুলেই থাকতো মা’কে। বারোটা বেজে যায়। বিজয় জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কোথায় ঘুমোবো?’
চৈতালী কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর হেসে বলে শকুন্তলাকে, ‘গেস্টরুমের বিছানাটা ঠিক করে দাও দিদিসোনা। চাদরটা চেঞ্জ করে দিও। আমার বেডরুমে এক্সট্রা বালিশ আছে, নিয়ে যেও’।
বিজয় আগে কখনও কলকাতায় আসেনি। চৈতালী বলে, ‘কাল তোমাকে ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামে নিয়ে যাবো, আর মার্বেল প্যালেসে। তোমার ভালো লাগবে’।
বিজয় ‘অ্যাট হোম’ বইটি হাতে নিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, ‘এই বইটা কি রাতে পড়ার জন্য নিতে পারি? এটা আমার পড়া হয়নি’।

৩.
যে কটা দিন ছিল বিজয়, কিশোর বয়সীদের মতো চৈতালী আর বিজয় কলকাতার রাস্তায় ঘুরেছে। ঝড়বৃষ্টি মানেনি। আগুন-রোদ মানেনি। রাস্তার কিনারের তেলেভাজা থেকে ভজহরি মান্না, কোনও খাবারই বাদ দেয়নি। হাতে-টানা রিক্সায় চড়েছে, গঙ্গায় নৌকো চড়েছে, যেদিকে খুশি সেদিকে হারিয়েছে। গন্তব্যহীন চলায় অদ্ভুত আনন্দ, চোখে পড়ার মতো কিছু নয়ও চোখে পড়ে। কলকাতায় জন্ম আর বড় হওয়া চৈতালীর। অথচ বিজয়ের সঙ্গে কলকাতা দেখতে গিয়ে টের পেয়েছে কলকাতার অনেক কিছু সে জানতো না। অনেক ঘ্রাণ সে নেয়নি আগে। যেন একটা অচেনা শহর। বিজয় কৌতুহলী লোক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখেছে সব, রাস্তার কিনারে কলের জলে দুপুরের বীভৎস গরমে স্নান করতে থাকা ছেলেদের সঙ্গে সাবান মেখে দিব্যি স্নানও করে নিয়েছে। তিলজলার বস্তিতে ঢুকে গিয়ে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভাব করে নিয়েছে। চৈতালী ভুলে গেছে তার চাকরি বাকরি, তার কন্যা, তার অতীত ভবিষ্যত। যেন সে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, সবার নাগালের বাইরে, কোনও অচেনা আকাশে সে। সত্যিকার ‘ক্লাউড নাইন’ বোধহয় একেই বলে। শকুন্তলাকে বিজয় উপহার দিয়েছে দুটো চমৎকার ঢাকাই শাড়ি, এত ভালো শাড়ি নাকি শকুন্তলা ইহজন্মে পরেনি। চৈতালীর জন্য যোগেন চৌধুরীর একটা পেইন্টিং। জীবনের অনেক কথা বলেছে সে বিজয়কে। স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের কথা, মেয়ের কথা, অশোকের কথা, এক রাশ দুঃখ সুখের কথা। সব চুপচাপ শুনেছে বিজয়। বিজয়ও বলেছে, তবে বলার চেয়ে বিজয় শুনতেই বেশি পছন্দ করেছে। মাত্র ক’টা দিনে খুব আপন হয়ে উঠেছে বিজয়। যেন বিজয় তার ছোটবেলার কোনও বন্ধু। যেন বিজয়ের সঙ্গে শৈশব কৈশোর জুড়ে চৈতালী এক্কা দোক্কা খেলেছে, মার্বেল লাটিম খেলেছে, পুকুরে মাছ ধরেছে। মাঝে মাঝে অতীতের কোনও ঘটনা বলতে গিয়ে চৈতালীর দুচোখ জল-আসে জল-আসে মতো হয়েছে। আলতো করে বুকে টেনে তাকে শান্ত করেছে বিজয়। বিজয়ের ওটুকু স্পর্শই পেয়েছে চৈতালি গোটা সাতদিনে। চুমু খেতে একবার দু’বার চেয়েছিল, কিন্তু নিজেই বারণ করেছে নিজেকে।

বিজয় চলে যায়, চৈতালীকে দিয়ে যায় চৈতালীর শ্রেষ্ঠ সময়। চৈতালীর আর জিজ্ঞেস করা হয়নি, ফেসবুকে সেক্সবয় নামের আড়ালে বিজয়ের চরিত্র কেন তার ফেসবুকের বাইরের বিজয়ের চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত? জিজ্ঞেস করেনি, অনুমান করে নিয়েছে, মায়ের মৃত্যুর কারণে যে ভীষণ গ্লানি আর শোকে ভুগছে বিজয়, তা থেকে মুক্তি পেতেই আশ্রয় নিয়েছে ফেসবুকে, ভিন্ন চরিত্রে। চৈতালী কেন আশ্রয় নিয়েছে ফেসবুকে! তার তো কোনও গ্লানি নেই, শোক নেই! কিছু হয়তো চৈতালীর ভেতরেও আছে, চৈতালী জানে না। বিজয় জানে কি? জিজ্ঞেস করা হয়নি বিজয় জানে কি না। এ ক’দিনে একবারও চৈতালীর শরীরে বান ডাকেনি। শুধু মনেই ঝরেছে ঝড়বৃষ্টি। চৈতালীর ফেসবুকের চরিত্রটা কি চৈতালীর সত্যিকারের চরিত্র নয়! চৈতালী ভাবে, কোন বিজয়টা সত্যিকারের বিজয়! যে বিজয়ের সঙ্গে নেটে দেখা হয়, নাকি যে রক্তমাংসের বিজয়ের সঙ্গে কলকাতায় দেখা হল! রক্তমাংসের বিজয়ই তো ফেসবুকের সেক্সবয়, যার সঙ্গে রাতে রাতে তার শরীরের উৎসব হয়। কত যে রহস্য একজন মানুষের ভেতর। সম্ভবত কয়েকজন মানুষ একসঙ্গে বাস করে একজন মানুষের মধ্যে। একজন আরেকজনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। একসঙ্গে কি সেই কয়েকজনকে পাওয়া সম্ভব নয়! নাকি একজনকে পেতে গেলে বাকিদের হারাতে হয়! চৈতালী চৈতালীরই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করে। সংবাদপত্রে চাকরি করা চৈতালী, মা চৈতালী, মেয়ে চৈতালী, ফেসবুকের চৈতালী, আর শকুন্তলার সঙ্গে কথা বলা চৈতালী –কোনওটার সঙ্গে মিল নেই কোনওটার। কিন্তু এক চৈতালী সামনে এলে আরেক চৈতালীকে কেন পিছু হটতে হবে! মানুষ কি তবে একজনের একটির বেশি চরিত্র ধারণ করতে পারেনা, এবং তাই নিজের একটি চরিত্রকেই পরিবেশন করে অন্যের সামনে! একসঙ্গে অনেকগুলো চরিত্র অন্যের সামনে উপস্থিত করলে কার অসুবিধে, সংস্কারের, সমাজের, নাকি মানুষের সীমাবদ্ধতার, অপারগতার! এসবই ভাবছিল চৈতালী যখন বিজয়কে এয়ারপোর্টে সি অফ করে বাড়ি ফিরছিল। উদাস তাকিয়ে ছিল গাড়ির জানালায়, তখন এসএমএস আসে।
বিজয় লিখেছে, আই লাভ ইউ।
বুক কাঁপে চৈতালীর। তীব্র ভালো লাগা মন থেকে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
চৈতালি লিখলো, মি টু।
ঘরে ফিরে দেখে সেই যে কণিকার সিডিটা বাজছিল, সেটা বেজেই চলেছে, কণিকার কণ্ঠে তখন, ‘চিরসখা হে ছেড়ো না মোরে…’
সঙ্গে সঙ্গে গায় চৈতালী, ‘চিরসখা হে ছেড়ো না মোরে…’