পররাষ্ট্র সচিব-বার্নিকাট বৈঠক: বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ না হওয়ায় উদ্বেগ

ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে সরকারের তরফে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় ফের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট। পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে গতকাল ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন তিনি। সেখানে গত ৩০শে মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠকে বার্নিকাট মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় মৃত্যুতে যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন সেই প্রসঙ্গও আসে। মানবাধিকার সংবেদনশীল রাষ্ট্র হিসেবে এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিস্তারিত তুলে ধরেন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট। সেগুনবাগিচায় মধ্যাহ্নের ওই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকাস অনুবিভাগ এবং মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্রমতে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন কানাডা সফর এবং জি-সেভেন আউটরিচ এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডুর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে আলোচনা হয়।
ওই বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হওয়া না হওয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়। চার দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী আজ কানাডা যাচ্ছেন। এ সফরে তিনি বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর সংগঠন জি-৭ এর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুুডোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী।
হত্যা কোনো সমাধান নয়: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে বিচারবহির্ভূত হত্যা মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যকর কোনো পন্থা নয়। এটি কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। মাদক অভিযানে মৃতের সংখ্যা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। সবার বিচার পাওয়ার অধিকার আছে বলে মনে করে দেশটি। সেগুনবাগিচার বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার দেশের এ অবস্থানই তুলে ধরেছেন বলে জানিয়ােচে্ছ সূত্রটি। উল্লেখ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট এমনটাই বলেছিলেন। সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল অবশ্য মাদক অভিযানে মৃত্যুর বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মন্ত্রীর ভাষ্য মতে, বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে না, মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করতে বাধ্য হচ্ছে। মন্ত্রীর এ ব্যাখ্যার বিষয়ে মার্কিন দূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে কোনো মন্তব্য না করলেও এ নিয়ে ফের উদ্বেগ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি দ্বিতীয় দফায় এটি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বানই জানালেন বলে মনে করেন কূটনীতিকরা। স্মরণ করা যায়- মাদক অভিযানে বন্দুকযুদ্ধ এবং মৃত্যুর ঘটনায় দেশ-বিদেশে উদ্বেগ বাড়ছে। পরিস্থিতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে জাতিসংঘ। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চেয়েছে ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিশনগুলো। ইইউ জোটভুক্ত দেশগুলোর ঢাকাস্থ মিশন প্রধানদের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়- “আমরা আশা করি, কর্তৃপক্ষ যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সন্দেহভাজন অপরাধীদের ?মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে। ঢাকায় ইইউ দেশগুলোর মিশনপ্রধানদের সম্মতিতে ইইউ ডেলিগেশন প্রধানের তরফে ওই বিবৃতি দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, মাদক ও এর চোরাকারবার বিশ্বজুড়েই একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশে যে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে, সেখানে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে, এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে ১২০ জনেরও বেশি মানুষ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে আইন ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেই সঙ্গে তারা যাতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ না করে- তা নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেয়া হয় বিবৃতিতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটছে অভিযান চালানোর সময় মাদক চোরাকারবারিদের সঙ্গে গোলাগুলিতে কিংবা মাদক বিক্রেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। তবে মানবাধিকারকর্মীরা বন্দুকযুদ্ধের মৃত্যুর ঘটনাগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলছেন, মাদকের উৎস বন্ধ না করে এভাবে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ ঘটিয়ে অভিযানের সফলতা আসবে না। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) গত ২রা জুন এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশে চলমান মাদকবিরোধী অভিযান বিষয়ে তারা গভীরভাবে নজর রাখছে।