ঈদের পর চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের আগে চার সিটিতে বড় ভোটযুদ্ধ। লড়াই হবে নৌকা আর ধানের শীষের। এই চার সিটির প্রধান দুই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই নির্বাচনী আমেজ। খুলনার মতো এই চার সিটিতেও জয় চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ জন্য আটঘাট বেঁধেই মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। বসে নেই বিএনপিও। তবে দলটি গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। এ নির্বাচন দেখে বাকি তিন সিটি নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা। নির্বাচন কমিশন জানায়, আগামী ২৬ জুন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ১৮ জুন থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হবে। রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে ভোট হবে ৩০ জুলাই। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে আসন্ন চার সিটির ভোট নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসির ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আশা করি, পেছনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের চার সিটিতে একটি সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন কমিশন।
চার সিটিতেই জয় চায় আওয়ামী লীগ : খুলনা সিটিকে মডেল ধরে চার সিটিতেই জয় চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন। কেন্দ্রীয় নেতারা দফায় দফায় গাজীপুর সিটিতে সফর করছেন। সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহীতে সমন্বয় সভা করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। নেতারা বলছেন, তিন কারণে চার সিটিতে জয় দেখছেন তারা। প্রথমত, টানা সাড়ে নয় বছর ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা সমভাবে পেতে সরকারদলীয় প্রার্থীকেই বিজয়ী করবে ভোটাররা। দ্বিতীয়ত, ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ। খুলনা সিটি নির্বাচন দলের নেতা-কর্মীদের বার্তা দিয়েছে, ঐক্যবদ্ধ থাকলে আওয়ামী লীগের জয়লাভ নিশ্চিত। সে কারণে সিটিগুলোতে দলকে ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে। গাজীপুরে স্থানীয় এমপি-মন্ত্রীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় সূত্রমতে, গতবার এই চার সিটিতে যে ভুলের কারণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছিল, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করতে চায় ক্ষমতাসীনরা। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক হয়ে পা বাড়াচ্ছে দলটি। এ ছাড়া খুলনা সিটিতে জয়ের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ফিরেছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে। খুলনার মতো গাজীপুর, রাজশাহী, বরিশাল এবং সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জিতবে বলে আত্মবিশ্বাসী দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, উন্নয়ন-অর্জনের যে ধারা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলছে এবং যার সুফল গাজীপুরবাসী পেয়েছে এবং পাচ্ছে। গাজীপুরের মানুষ গতবার যে ভুল করেছে, সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি এবার তারা করতে চায় না। আমরা আশাবাদী গাজীপুরেও আমাদের প্রার্থী বিজয়ী হবে। অন্য সিটিতেও আমরা বিজয়ী হব।
দলীয় সূত্রমতে, রাজশাহী সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক মেয়র ও কেন্দ্রীয় নেতা এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং সিলেটে সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমেদ কামরান। এ দুজনকে গত বছরই মনোনয়নের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বরিশাল সিটিতে নতুন মুখ আসবে। স্থানীয় নেতাদের মতামত ও বিভিন্ন জরিপের ভিত্তিতেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ এখন ঐক্যবদ্ধ বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন। সিলেটে কিছু জটিলতা রয়েছে। প্রার্থী চূড়ান্ত করা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে নেতারা মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খুলনার বিজয়ে দলীয় প্রচারণায় যে মূলমন্ত্র কাজে লাগানো হয়েছিল তা গাজীপুরসহ চার সিটিতেও লাগানো হবে। খুলনায় আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে ছিল। গাজীপুরেও তাই হবে।
গাজীপুর দেখে অন্যগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি : চার সিটি নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেখে বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীতে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে নেতারা বলেন, খুলনা নির্বাচন যে কায়দায় হয়েছে, একই চিত্র গাজীপুরেও দেখা গেলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ভাবতে হবে। এভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে লাভ হবে না। তাই গাজীপুর সিটিকে টেস্ট কেস হিসেবে নিতে হবে। আর চার সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে বোঝা যাবে জাতীয় নির্বাচনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কী হবে।
বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘খুলনায় যেভাবে ভোট ডাকাতি হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে বিএনপিকে ভাবতে হবে। তবে আমরা গাজীপুর সিটি নির্বাচনে অংশ নেব। সেখানে সরকারের ভূমিকা কী হয়, তা পর্যবেক্ষণ করা হবে।
জানা যায়, খুলনা সিটি থেকে শিক্ষা নিয়ে গাজীপুরে এবার ভিন্ন কৌশলে এগোবে বিএনপি। ভোটের আগের রাতেই কেন্দ্র পাহারা দেওয়া হবে। ভোট ডাকাতি হলে প্রতিরোধ-প্রতিহত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। তাছাড়া ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রের বাইরেও শোডাউন করা হবে। ভিতরে ভোট ডাকাতি বা কারচুপি হলে তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মিছিল বের করা হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতমূলক আচরণ করলে ঢাকায় বিক্ষোভ-মিছিলের পাশাপাশি দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানানো হবে। ভোটচুরি ঠেকাতে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতিই নেওয়ার কথাই ভাবছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।
সূত্র জানায়, গাজীপুরে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সব নেতাদেরই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে বিএনপি মাঠে নামবে। এরপরও যদি সরকার গণরায় পাল্টানোর চেষ্টা চালায় তাহলে তা নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠ গরম করা হবে। গাজীপুর থেকেই আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরির চিন্তাভাবনা রয়েছে দলটির।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘খুলনায় যে কৌশলে সরকার ভোট ডাকাতি করেছে, আমরা তা নিয়ে ভাবছি। আমরা পাল্টা রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে কাজ করব। যে কোনো মূল্যে ভোট ডাকাতি বন্ধ করা হবে। মোটামুটি সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়ী হবে।
গাজীপুর সিটির কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন বলেন, ‘খুলনা আর গাজীপুর এক নয়। গত নির্বাচনে বিএনপি দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছে। এবার সুষ্ঠু ভোট হলে অন্তত ২ লাখ ভোটের ব্যবধানে ধানের শীষের প্রার্থী জয় লাভ করবে।’
১২ জুনের মধ্যে প্রস্তুতির নির্দেশ ইসির : ইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ২৮ জুন আর প্রার্থিতা যাচাই-বাছাই ১ ও ২ জুলাই। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ জুলাই। ১০ জুলাই চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করবে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা। এ ছাড়া তিন সিটিতে ইভিএম ও সিসি টিভি ব্যবহারের কথাও রয়েছে।
তিন সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী ১২ জুনের মধ্যে এসব সিটির সর্বশেষ হালনাগাদ ভোটের তালিকার (ছবিসহ-ছবি ছাড়া) সিডি প্রস্তুত করতে ভোটার তালিকা অনুবিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন। সেই সঙ্গে এই তিন সিটির ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
গাজীপুরে ৬ ভোটকেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব : এই সিটিতে ছয় ভোটকেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছেন ইসির যুগ্ম-সচিব ও রিটার্নিং অফিসার রকিব উদ্দিন মণ্ডল। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গাজীপুর সিটির ছয় কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছি। ইসি সিদ্ধান্ত নেবে কয়টিতে ইভিএম ব্যবহার হবে। সেই সঙ্গে তিনটি ভোট কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার হবে বলেও জানান তিনি। ভোট প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তুতি চলছে। প্রার্থীদের চিঠি পাঠানো হয়েছে যাতে কেউ ১৮ জুনের আগে প্রচার-প্রচারণা না চালায়।