বাতিল মোবাইল ফোন কম্পিউটারে বড় বিপদ

উন্নত বিশ্বে ব্যবহার হওয়ার পর কম্পিউটার, কম্পিউটারের যন্ত্রাংশের মতো পুরনো ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য আনা হচ্ছে দেশে। এসব পণ্য থেকে দূষণ ছড়িয়ে মানবদেহে দেখা দিচ্ছে ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগব্যাধি। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব পণ্য আনার বিষয়ে কঠোর হচ্ছে সরকার। ‘ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য হইতে সৃষ্ট বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা ২০১৮’ বিধিমালায় পুরনো বা ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

বিধিমালার ১৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‘দাতব্য, অনুদান বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কোনো পুরনো বা ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি অনুমোদন করা হইবে না।’ বিধিমালার ওপর সব অংশীজনের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে সেটা।

বিধিমালা সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মেয়াদ শেষ হওয়া এসব যন্ত্রাংশ পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। আমরা এসব যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করতে চাই। সে জন্য বিধিমালায় এই ধারা সংযোজন করা হয়েছে।’ পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, বিদেশ থেকে যেসব যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে ঢুকছে, সেগুলোর মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ সাধারণত মাটির সঙ্গে মেশে না। এসব যন্ত্রাংশ পচেও না। এসব যন্ত্রাংশে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ আছে, যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের  জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ক্যান্সার, কিডনির জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের ব্যাধির অন্যতম কারণ এসব যন্ত্রাংশ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর তিন কোটি মোবাইল ফোনসেট নষ্ট হচ্ছে। পাঁচ লাখ কম্পিউটার ও ল্যাপটপ নষ্ট হচ্ছে। সারা বিশ্বে প্রতিবছর চার কোটি টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য তৈরি হয়।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে এখন ১৩ কোটির ওপরে মোবাইল ফোনসেট রয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি বাসাবাড়িতে নষ্ট মোবাইল ফোনসেট পাওয়া যাবে। এসব ই-বর্জ্য পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব বর্জ্য একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ করে, অন্যদিকে খাবারের মধ্য দিয়ে মানবদেহে ফিরে আসে।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে এ ধরনের ই-বর্জ্য বাংলাদেশে হরহামেশাই ঢুকছে। এসব পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে দেওয়া জরুরি। আমরা এটিকে স্বাগত জানাই।’

একই মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এনায়েত হোসেনের। তিনি বলেন, ‘এসব ই-বর্জ্য অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসার কারণে অনেক ধরনের মারাত্মক রোগ-ব্যাধি হচ্ছে। এসব ই-বর্জ্য আমদানি নিষিদ্ধ আরো আগেই করা উচিত ছিল।’

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের এমন ক্ষতির মধ্যে আজ সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি, প্লাস্টিক পুনঃ ব্যবহার করি, না পারলে বর্জন করি’।

দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে সরকার ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। পরিবেশ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তুলতে ১৯৭২ সাল থেকে প্রতিবছর এই দিন দিবসটি পালন করে আসছে বিশ্ব।

এরই মধ্যে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে জৈব পচনশীল পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার চিন্তাভাবনা শুরু করেছে সরকার। একই সঙ্গে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার কিভাবে পুরোপুরি বন্ধ করা যায়, সেই উপায় খুঁজছে সরকার। আগামীকাল ৬ জুন এ বিষয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে এক আন্ত মন্ত্রণালয় সভা হওয়ার কথা রয়েছে। যারা জৈব পচনশীল ব্যাগ ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, তাদের উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি কিভাবে প্রণোদনা দেওয়া যায়, সে বিষয়েও সভায় আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।

পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট থেকে পলিমার উদ্ভাবন এবং সেটা দিয়ে ব্যাগ তৈরি করেছেন বিজ্ঞানী ড. মুবারক আহমেদ খান। এ ছাড়া জৈব পচনশীল ব্যাগ তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছে এক্সপো অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড, ইকোস্পিয়ার প্রাইভেট লিমিটেড। তাদের তৈরি করা পরিবেশবান্ধব ব্যাগ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চায় সরকার। ৬ জুনের সভায় সব পক্ষকে থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

পলিথিন ব্যাগ উত্পাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও প্রশাসনের নাকের ডগায়ই সব কিছু চলছে প্রকাশ্যে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়, যার মধ্যে সাড়ে আট শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য। সে হিসাবে প্রতিদিন দুই হাজার টন আর মাসে ৬০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর দুই হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি করা হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) তথ্য মতে, সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরি করা হয়। প্রতিবছর সারা বিশ্বে ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুলতান আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্লাস্টিকজাতীয় পণ্য কখনো পচে না, যার কারণে এই প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি করছে। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মাছ পশুপাখির মাধ্যমে খাদ্যচক্রে ঢুকে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে জমির উর্বরতা নষ্ট করছে। পানি নিষ্কাশনের পথও রুদ্ধ করছে এই প্লাস্টিক বর্জ্য।

কিন্তু নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও শেষ কবে অভিযান হয়েছে ভুলে গেছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। আইন করেও কেন অবৈধ পলিথিন ব্যবহার ঠেকানো যাচ্ছে না—এমন প্রশ্নে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এর সঙ্গে মানুষের সচেতনতা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভিযান পরিচালনা করতে পুলিশের প্রয়োজন হয়। একজন ম্যাজিস্ট্রেট লাগে। কিন্তু আমরা চাইলেও পাই না। ম্যাজিস্ট্রেট এলে এক মাস, সর্বোচ্চ তিন মাস পর এখান থেকে বদলি হয়ে চলে যান। এর সঙ্গে আমাদের নিজস্ব জনবলেরও অভাব আছে। এসব কারণে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে অভিযান করা যায় না।’

এদিকে পরিবেশদূষণ রোধে প্লাস্টিকের বেআইনি উত্পাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। জার্মানিভিত্তিক সংস্থাটি বলেছে, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে প্লাস্টিকের অবৈধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি দূষণ কর ব্যবস্থাও চালু করা যেতে পারে।’

এদিকে কক্সবাজারে প্রাকৃতিক সম্পদ পুনরুদ্ধারে আলাদা ‘পরিবেশ তহবিল’ গঠনের দাবি জানিয়েছে কয়েকটি সংগঠন। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং বিসিএএসের (বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ) নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান বলেন, বন মানে শুধু কিছু গাছ নয়। বন মানে অনেক প্রাণ ও প্রতিবেশের সমাহার এবং একবার এই প্রতিবেশ হারিয়ে ফেললে তা গাছ লাগিয়ে পূরণ করা যায় না।

বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে প্রতিদিন আড়াই হাজার গাছ কেটে জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। শুধু প্রতিদিনকার রান্নার জন্য জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে এই কাঠ জোগাড় করা হচ্ছে পাশের বন থেকে। এভাবে চললে ২০১৯ সালের মধ্যে উখিয়ার সম্পূর্ণ বন উজাড় হয়ে যাবে। ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর দৈনন্দিন জীবনযাপনের ফলে টেকনাফ ও উখিয়া এই দুই উপজেলার ২১টি খাল ও ছড়া পুরোপুরি দূষিত হয়ে গেছে।