মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের দ্বারা ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া হাজারো রোহিঙ্গা নারী জন্ম দিতে শুরু করেছেন অপ্রত্যাশিত শিশু।
বাংলাদেশের দিকে বড় আকারে রোহিঙ্গা ঢল নামার ৯ মাস পার হয়েছে । ফলে সে সময় রাখাইনে ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গা নারীদের গর্ভের সন্তান জন্ম নেয়াও শুরু করেছে। এমন সন্তানসম্ভবা রোহিঙ্গা নারীর অধিকাংশেরই বয়স আঠারোর নিচে। আগামী কয়েক মাসে সন্তান প্রসবের এই হার আরও বাড়বে বলে জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা।
এমনই এক বিধবা মা উমা সুলেইমান, প্রত্যেকদিন রাতে বুকে জড়িয়ে আগলে রাখেন শিশুকে। সন্তানের পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।
তার অন্য সন্তানদেরও একইভাবে ভালোবাসেন, আগলে রাখেন এই মা। কিন্তু তিন মাসের ওই সন্তানকে যখন বুকে টেনে নেন তখন এক দুঃস্বপ্ন তাড়া করে তাকে।
গত বছরের দুঃসহ এক ক্ষতের চিহ্ন নিষ্পাপ এই শিশু। ওই সময় মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনী উমা সুলেইমানদের গ্রামে ঢুকে পড়ে। তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় পাশের একটি ধানক্ষেতে। সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত দু’জন তাকে পালাক্রমে ধর্ষণের পর রক্তস্নাত অবস্থায় সেখানেই ফেলে রেখে যায়।
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর পরিকল্পিত অভিযানের সময় ধর্ষণের শিকার হাজার হাজার নারীদের একজন তিনি। আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা রাখাইনে নিরাপত্তাবাহিনীর এই অভিযানকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছে। তবে নৃশংস অভিযানের অভিযোগ বারংবার প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
বাংলাদেশের জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরে ৯ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এই রোহিঙ্গারা নিজ বাড়ি-ঘরে আগুন, শিশুদের শিরশ্ছেদ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের গুলিতে প্রাণ হারানোর দুঃসহ ঘটনার স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেননি। এসব ঘটেছে তাদের চোখের সামনেই।
নিরাপত্তাবাহিনীর ধর্ষণ থেকে রেহাই না পাওয়ায় এখন কয়েক হাজার নারী ও তরুণী অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের মা হচ্ছেন। রোমহর্ষক স্মৃতি নিয়ে বাঁচার লড়াই করছেন তারা।
চিকিৎসকরা বলছেন, অনেক নারী ও তরুণী দাতা সংস্থাগুলোর ক্লিনিকে তাদের গর্ভাবস্থার অবসান ঘটাচ্ছেন। একেবারে সস্তা মূল্যের ওষুধ সেবন করছেন তারা। এর ফলে অনেকের স্বাস্থ্য জটিলতাও দেখা দিচ্ছে।
অত্যন্ত রক্ষণশীল রোহিঙ্গা সমাজে অনেক নারীই এখন পরিবার-পরিজনের চোখে কলঙ্কিত। পাশাপাশি শূন্য হাতে পরিবারের সদস্যরাও তাদের সেবা-যত্ন করতে অনীহা দেখাচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হচ্ছেন এই রোহিঙ্গা নারী ও তরুণীরা।
সন্তান জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্ত সবচেয়ে কঠিন একটি সিদ্ধান্ত ছিল উমা সুলেইমানের, কারণ তিনি বিধবা। কয়েক বছর আগে রোগাক্রান্ত স্বামী মারা যায় তার। রোহিঙ্গা এই নারীর বয়স মাত্র ৩০ হলেও রয়েছে পাঁচ সন্তান।
১৬ বছর বয়সে বড় মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পর কক্সবাজারের বালুখালি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অন্য সন্তানদের লালন-পালন করছেন তিনি।
অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের জন্ম দেয়ার ব্যাপারে উমা সুলেইমান বলেন, আমি এই সন্তান চাইনি।
গত বছরের জুনে রাখাইনের মংডু জেলায় প্রায় হাফ ডজন সেনাসদস্যের ধর্ষণের শিকার হন ২৫ বছর বয়সী ফাতেমা। যখন তাদের বাড়িতে সেনাসদস্যরা হামলা চালায় তখন জীবন বাঁচাতে পাশের জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেন তার স্বামী মোহাম্মদ হুসেইন।
এ ঘটনার চার মাস পরে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা হয় ফাতেমার। এসময় হুসেইন দেখেন তার স্ত্রী গর্ভবতী। ফাতেমা বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়, আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি ভেবেছিলাম, সে আমাকে তালাক দেবে।
কিন্তু তাদের প্রথম সন্তান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুই বছর আগে মারা যায়। ফলে এই সন্তান সেই যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেবে বলে তারা চিন্তা করেন। মোহাম্মদ হুসেইন বলেন, আমরা কখনোই গর্ভপাতের কথা মাথায় আনিনি। এ ধরনের ঘটনা অনেক নারীর সঙ্গেই ঘটেছে। আমরা মনে করি, আল্লাহ এই সন্তানের লালন-পালনের ব্যবস্থা করবেন।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্টিয়ারসের (এমএসএফ) মার্সেল্লা ক্রেয়ায় বলেছেন, শরণার্থী শিবিরে চলতি বছরে প্রায় ৪৮ হাজার সন্তান জন্ম দেবেন। যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল তারা শিগগিরই সন্তানের মা হবেন। তবে এদের অধিকাংশই মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে গোপনে অথবা বাঁশের খুপরি ঘরে কোনো ধরনের মেডিক্যাল সহায়তা ছাড়াই কঠিন এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না মিয়ানমার সরকার। সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চার দশক ধরে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপত্তা চৌকিতে কথিত হামলার অভিযোগ তুলে সেনা অভিযানের নামে নৃশংসতা শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এদের আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারে উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত খুঁজে পেয়েছে বলে জানিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’বলেও আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছে। তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সমস্ত অভিযোগই বরাবরের মতো অস্বীকার করে আসছে।