গত ২ বছর ধরেই চলচ্চিত্র পাড়া বিভাজিত হয়ে এমন এক জায়গায় ঠেকেছে যে, কারো সাথে কথা বললেই পাশ থেকে কেউ প্রশ্ন করেন, ভাই আপনি কার পক্ষের লোক? অথচ অধিকাংশের মুখেই বিভিন্ন টকশো বা কথাবার্তায় তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন তিনি চলচ্চিত্রের পক্ষের। চলচ্চিত্রের পক্ষের বলেই সে তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। যেন এটি সরকারি-বিরোধীদলের মতো এক বিশাল বাহাস! কেন এই বিভাজন? কেন এই দ্বন্দ্ব? সামান্য ইফতার পার্টি নিয়ে ওমর সানী- জায়েদ খান পরস্পরকে দোষ দিচ্ছেন। ফেসবুকে ওপেন সারা বিশ্ববাঙালি দেখছে। ক্ষতিটা কার হচ্ছে। এই ইন্ডাস্ট্রির। হাস্যরসে পরিণত হচ্ছে চলচ্চিত্রশিল্পী সমাজ! কে সঠিক, কে বেঠিক সেই প্রশ্ন এখানে না, কিন্তু দিনদিন চলচ্চিত্রশিল্পী সমাজ বিভাজিত হচ্ছে। এটা এখন দূর গ্রামের এক দর্শকরাও জানেন ফেসবুক ইউটিউবের কল্যাণে। জায়েদ খান বলছেন, ‘আমরা নীতি অনুযায়ী কাজ করছি। কারণ এর আগে শিল্পী সমিতির এত সুন্দর চাকচিক্য কেউ দেখেনি।’ তবে কেন এই গ্রুপিং? আর নেতৃত্বের আসনে বসলে তো দায় নিতেই হবে। প্রত্যাশার চাপও থাকবে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন শাকিব খানকে নিয়ে। শাকিব খান একাধিক ইন্টারভিউতে বলেছেন যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমি এদেশে নিষিদ্ধ!’ শাকিব খানের চালবাজ মুক্তি নিয়ে নানা কথা রটেছে। এমনিতেই হলের খরা। অন্যদিকে জাজ মাল্টিমিডিয়াকে দোষ দিচ্ছেন প্রযোজকরা যে, এই প্রতিষ্ঠান ছবির ব্যবসা হতে দিচ্ছে না। এসব কথা ওপেন সেমিনার, টকশোতে বলছেন। অপরদিকে দীর্ঘদিনের নেতৃত্বহীন প্রযোজক সমিতির কোনো দাপুটে ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না বা দেখাতে পারছে না। কেন এই বিভাজন? এই প্রশ্নের জবাব কে জানেন? প্রতিটি ক্ষেত্রে। এই দায় চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সমিতির নয় কী? কারণ এটা দিব্যলোকের মতো সত্য যে, বর্তমান চলচ্চিত্রের বাজারে শাকিব খানের মতো সফল তারকা নেই। কিন্তু দেশীয় ছবির শিডিউল থেকে ক্রমাগত তার নাম বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে কি অদূর ভবিষ্যতে শাকিব খানের ছবি আমদানিকৃত ছবি পদ্ধতিতেই দেখবে দর্শকরা। জনপ্রিয়তার শীর্ষ অবস্থানকে ঈর্ষা করেন অনেকেই। থাকতেই পারে শাকিব খানের কিছু ভুল। কিন্তু সেখানেও তো শুধরানোর পথ থাকতে হবে! আর একচেটিয়া জনপ্রিয়তা হলে সেখানে কিছু দায়-দায়িত্ব বা নিজস্ব ভুল বোঝাবুঝি প্রকট হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন শাকিব খানের সাথে এই মতবিরোধ বা একাধিক গ্রুপিংয়ের ফলে রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হয়ে উঠছে ইন্ডাস্ট্রি! ওপার বাংলায় কি শাকিব খানই প্রথম কাজ করছেন। এর আগে নায়করাজ থেকে শুরু করে এদেশের একাধিক নামীদামি তারকারা নিয়মিত ও একাধিক চলচ্চিত্র করেছেন। সেক্ষেত্রে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নানা কাগুজে ফাঁক ফোকর বা নীতিগত ভুলগুলোকে কি সংগঠনগুলো শুধরে নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির কথা ভাবতে পারেন না? সম্প্রতি আশিকুর রহমানের ‘সুপার হিরো’ ছবিটি মুক্তি নিয়েও নানা জটিলতা দেখা গেছে। সাধারণ দর্শকরা কিন্তু সমিতি বা সংগঠনের সংবিধান মুখস্থ করে ছবি দেখতে আসেন না। তাই বিষয়গুলো জরিমানা বা আলোচনা সাপেক্ষে হলেও ছবি রিলিজ ব্যাহত হলে ১২০০-৮০০-৩০০ এই অবনতির দিকে হল সংখ্যা নামবে। আমাদের আত্মবিশ্বাস, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হওয়ার নয়। কিন্তু শাকিব গ্রুপ, মিশা-জায়েদ গ্রুপ, ওমর সানী-অমিত হাসান গ্রুপ, জাজ গ্রুপসহ বিভিন্ন অপ্রকাশ্য গ্রুপিংয়ের খবর যখন এফডিসির খা খা করা ফ্লোরগুলো গুনতে থাকে তখন ইন্ডাস্ট্রির জন্য এক বিশাল হাহাকারের জন্ম দেয়! এফডিসিতে কেউ হাঁটলেও এখন পাশে থেকে বলে ওঠে ‘আরে ও তো জাজের লোক!’ এই জটিল অবস্থার জন্য যে দায়ী হোক পদক্ষেপ নিতে হবে সংগঠনগুলোর। শাকিব খানকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘দেখেন, আজ সাকিব আল হাসান আইপিএল-এ খেলছে। সাকিবের দলকে বাংলাদেশিরা নিজেদের দল ভাবছে। এখন সে কি ইন্ডিয়ান হয়ে গেল? এসব ছবির প্রযোজক তো আমি নই? কিন্তু আমি তো চাইবোই আমার ছবিটি যেকোনো মূল্যে নিজের দেশে মুক্তি পাক। আমার দেশের দর্শকরা দেখুক। চালবাজ উত্সবে মুক্তি দিতে দিলেন না। উত্সবের বাইরেও তো সুপার-ডুপার হিট করলো। এখন আমাকে ব্যবহার করুন সবাই। দেশের প্রযোজককে আমি সর্বাগ্রে রাখছি। এরপরও আমার ছবি নিয়ে যত সমস্যা, কেন? এখানে আমার কিন্তু কোনো ক্ষতি নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি শিল্পী হিসেবে আমার কাজটি করে যাচ্ছি। এসব না ভাবলেও আমি বিন্দাস ভালো থাকবো। কিন্তু আজ সুপার হিরো বন্ধ করতে হবে। কোনো এক বেনামি প্রতিষ্ঠান অভিযোগ দেবে, সেই প্রেক্ষিতে। হ্যাঁ, ছবির প্রযোজক তাপসী প্রথমবারের মতো বাইরে কাজ করেছে। তিনি একজন সুপ্রতিষ্ঠিত নিয়মিত প্রযোজক। তার তো ভুল হতেই পারে। আরে ভাই সে তো মানুষ খুন করেনি। এখন আপনি তাকে নানাভাবে নাজেহাল করলে কি লাভ হবে ইন্ডাস্ট্রির? তাকে জরিমানা করেন বা শর্ত দেন, যা-ই করেন ছবিটি সময়মতো রিলিজ করতে দেন, যাতে তার মতো নিয়মিত প্রযোজক হতাশ না হয়ে যায়। এমনিতেই নানা সময়ে অগণিত প্রযোজক দূরে সরে গেছে। আজ আমার ছবি দিয়ে কোনো প্রযোজক ব্যবসা করলে পরের ছবিতে অন্য একজন হিরোকে নিয়ে সে ট্রাই করবে। এতে ইন্ডাস্ট্রি বড় হবে। অথচ সবাইকে দেখছি এখন ছবি প্রযোজনা বাদ দিয়ে বোদ্ধা সেজে জ্ঞান দিচ্ছেন। ভাই যারা ছবিতে লগ্নি করছে তাদেরকে এখন সবাই মিলে সাপোর্ট দেওয়া দরকার। সেটা যার ছবিই হোক। কারণ এই ভয়াবহ বাজারে যে প্রযোজক ছবি নির্মাণে আছেন তিনি ভীষণ প্রেম থেকেই কাজ করছেন। কিন্তু আপনি আপনারা তাকে নানা নীতিমালার ফাপরে অস্থির করে তুলছেন। সবার আগে এই ইন্ডাস্ট্রি তো দর্শকবান্ধব করতে হবে। বড় বড় বাজেটের ছবিগুলো হলে নিয়মিত আনলে দর্শকরা হলে যাওয়ার প্র্যাকটিক্স করবে। নয়তো সবার হাতেই তো ডিজিটাল ডিভাইস। তাদের প্রত্যেকের হাতে বিশ্ববিখ্যাত ছবির লিঙ্ক আছে। তাদেরকে আগে হলে ফেরান।’ শাকিব খানের এই কথার ওপরও হয়তো নানা টেকনিক্যাল ভুল ধরতে পারবেন শিল্পী-প্রযোজক নেতা-নেত্রীরা। কিন্তু ছবির বাজারে যে লগ্নি উঠে আসার গল্প সবাই ভুলতে বসেছে, শাকিব খানের ছবিতেই যে হল চাঙা হয়ে ওঠে। প্রযোজক হল মালিকের কাছ থেকে অগ্রীম টাকা পায়। এসব তো ধ্রুব সত্য! তাই শাকিব খানকে বিভিন্ন কায়দায় চলচ্চিত্রের শত্রু না বানিয়ে বরং তাকে ব্যবহার করাটা খুব জরুরি। হয়তো এ লেখাটিরও বিপক্ষ মত তৈরি হতেই পারে। কিন্তু মতপার্থক্য তৈরিরও আগে জরুরি এক টেবিলে চিত্রনায়ক ফারুক, মিশা সওদাগর, জায়েদ খান, আব্দুল আজিজ ও শাকিব খানের দীর্ঘ আলোচনা। যে আলোচনায় চলচ্চিত্রের স্বার্থ খুঁজবে সবাই। সকলে একমত হয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দেবেন। সেদিনের অপেক্ষায় সুদিনের ক্যালেন্ডার খুঁজছে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা। কারণ মফস্বলের এক সাধারণ দর্শক বারবার এই বিভাজনের গল্পে শুধু বিভ্রান্ত হচ্ছে। আর ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশি ছবি থেকে। সেই দূরে সরার অভ্যেসে ভালো ছবিগুলোর অপমৃত্যু হচ্ছে! এই অপমৃত্যু ঠেকানোর দায়িত্ব আপনাদের। যে নামগুলো উল্লেখ করলাম তাদের একজোট হওয়া সবচেয়ে জরুরি। শিল্পী নেতৃবৃন্দ কিভাবে করবেন, কবে করবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু বিষয়টি জরুরি। ভীষণ জরুরি!