শান্তি মিশনে বাংলাদেশের নারী পুলিশ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে মানবতাকে বাঁচাতে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর গঠিত হয় জাতিসংঘ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বশান্তি রক্ষায় নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘ এগিয়ে যাচ্ছে সগৌরবে। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, আন্তর্জাতিক যে কোনো সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘের বিকল্প নেই। বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক শান্তিরক্ষা মিশন পরিচালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ সম্মিলিতভাবে এই শান্তিরক্ষা মিশনে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে গোড়া থেকেই।

১৯৮৮ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার পর্যবেক্ষক হিসেবে ১৫ জন সেনা সদস্য প্রেরণ করে আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় গৌরবের সূচনা করে। এরপর ১৯৮৯ সালে নামিবিয়া শান্তি রক্ষা মিশনে যোগদান করে বাংলাদেশ পুলিশ। ১৯৯৩ সালে যোগদান করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী । এ পর্যন্ত জাতিসংঘের ৬৬ টি মিশনে বাংলাদেশের শান্তি রক্ষীর সংখ্যা ১৫৩৮৫৮ জন। আর বর্তমানে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কাজ করছে ২১ টি মিশনে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের শান্তি রক্ষীর সংখ্যা ১৮৪১৯ জন, যার মধ্যে ১১১১ জন সাহসী নারী। আর বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষী হিসেবে কাজ করছে ৮০৫ জন পুলিশ সদস্য, যার মধ্যে ৭৫ জন নারী। সামরিক, নৌ ও বিমানবাহিনীর ন্যায় শান্তিরক্ষী মিশনে নিজেদের সাহসিকতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে সকলের নজর কেড়েছে বাংলাদেশ পুলিশের গর্বিত সদস্যগণ। বিভিন্ন মিশন এলাকায় নানা বৈরিতা ও প্রতিকূলতাকে তারা দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপন্ন মানবতার সেবায় সর্বদা পেশাদারীত্ব নিয়ে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ পুলিশ।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নারী পুলিশ সদস্যদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশ পুলিশের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানি। শুধু অংশগ্রহণ নয়, প্রথম থেকেই বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের সাফল্য ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। গর্বিত এ দলের সদস্য আমিও। একজন নারী পুলিশ সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করার জন্য সাহসী ও দৃঢ় মনোবল থাকা প্রয়োজন।

প্রথমত, সন্তানের দেখাশুনার ভার, সন্তানের লেখাপড়া এবং স্কুলে পাঠানো, মায়ের অনুপস্থিতিতে শূন্যতা পূরণ, মায়ের টেনশন সবকিছু মিলিয়ে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। এরপর আছে বাড়তি টেনশন, যেমন- স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের সমর্থন থাকবে কিনা, সন্তানকে দেখাশুনার ভার কার উপরে ন্যস্ত করা হবে, এক বছরের খরচাপাতি কে বহন করবে ইত্যাদি। মনে হতে পারে এগুলো খুবই নগণ্য বিষয়। বাস্তবিক অর্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এগুলোই বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করি। ব্যানএফপিইউ-১ এ আমরা কিনসাসা, ডিআর কঙ্গোতে গিয়েছিলাম ১২৫ জনের একটি কন্টিনজেন্ট। তার মধ্যে ৭২ জন মহিলা সদস্য এবং ৫৩ জন পুরুষ সদস্য। এই ৭২ জনের মধ্যে ৯ জন কমান্ডিং স্টাফসহ মোট অফিসার ৩৬ জন এবং বাকী ৩৬ জন মহিলা কনস্টেবল। বাস্তবতা হচ্ছে, এদের মধ্যে মাত্র ২% আছে যারা স্বামী এবং অভিভাবকের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশনে গিয়েছেন। বাকীরা গিয়েছেন নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে। আর ৪% তাদের সন্তানকে স্বামীর বা শ্বশুর শাশুড়ির কাছে রেখে এসেছেন, বাকীরা সন্তানকে রেখে এসেছেন মায়ের কাছে। (উল্লেখ্য, এই হিসেবের মধ্যে যারা বিবাহিত নন এরকম ৫%ও রয়েছে।) একজন নারী কর্মক্ষেত্রে কতটা স্বাধীন তার থেকেও বড় প্রশ্ন-সে পরিবারে কতটা স্বাধীন?

মিশন চলাকালে পুলিশ সদস্যদের খুব কম সংখ্যক ছুটিতে দেশে যেতে পারে। সেইক্ষেত্রে এক বছরের জন্য প্রস্তুতি বড় বিষয়। কোন মিশন এরিয়াতে কি কি বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন প্রয়োজন বা উক্ত সময়ে কি কি কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে এ বিষয়ে পূর্ব ধারণা থাকলে মানসিক প্রস্তুতি ভালোভাবে নেওয়া সম্ভব। রোটেশন চেঞ্জ এর যুক্তিগ্রাহ্য সময়ের পূর্বেই পরবর্তী রোটেশন এর প্রশিক্ষণ প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত, যাতে নির্ধারিত সময়েই রোটেশন সম্ভব। কারণ সন্তান এবং পরিবারের জন্য অপেক্ষার ধৈর্য হারিয়ে ফেলাটাই স্বাভাবিক। যদিও পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই তারপরও সত্যিকার অর্থে সময়ের শেষ সীমায় পৌঁছালে দেশের প্রতি মায়া বেড়ে যায়। দেশে ফেরার এই ক্ষণ পিছিয়ে গেলে কর্মচঞ্চলতাও কমে যায় অন্যদিকে অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে পারিবারিক সমস্যাগুলো ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ে। তাই সকল সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ পুলিশকে অধিকতর মনযোগী হতে হবে এবং সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন বাংলাদেশের নারী পুলিশের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি হোক এটাই প্রত্যাশা।