রংমহল ছেড়ে পালাচ্ছে ইয়াবা ‘বাবারা’

বাবারা পালিয়েছে। আর বাবাদের বাবা হিসেবে পরিচিত আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বাবা সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে তাদের এলাকায় প্রচার করা হচ্ছে তিনি সৌদি আরব গেছেন। মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে বদির আপন বেয়াইসহ ঘনিষ্ঠজন বন্দুকযুদ্ধে নিহতের পর তিনি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এরপরই সৌদি আরবে ওমরাহ পালনের নামে সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। জানা গেছে, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বহুল সমালোচিত কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি ওমরাহ পালন করতে দেশ ছেড়েছেন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি বেসরকারি বিমানের ফ্লাইটে দেশ ছাড়েন তিনি। আব্দুর রহমান বদির সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছে তার মেয়ে, মেয়ের জামাই, নুরুল আক্তার, গিয়াস উদ্দিন ও মো. আলী আহমদ। আর বদির ব্যক্তিগত সহকারী হেলাল উদ্দিন বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন। তিনি ওমরাহ করতে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, রমজানের শেষ সপ্তাহজুড়ে তিনি মসজিদ আল-হারামে ইতেকাফ করার নিয়ত করেছেন। ওমরাহ পালন শেষ আগামী ১৭ জুন দেশে ফেরার কথা রয়েছে। আব্দুর রহমান বদির ঘনিষ্ঠজন সূত্রে জানা গেছে, তিনি সহজেই দেশে ফিরবেন না। দেশে চলমান মাদকবিরোধী অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সৌদি আরবেই অবস্থান করবেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে তার দেশে ফেরা।ইয়াবা নামক এই মরণ নেশার ট্যাবলেটের ব্যবসা করে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রাচীন রাজাদের মতো প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন তারাও তাদের সেই রংমহলগুলো ছেড়ে পালিয়েছেন। মাদকবিরোধী দেশজুরে অভিযানের পর ওইসব ইয়াবা বাবারা পালিয়েছে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজার জেলার টেকনাফে এই ইয়াবার ব্যবসা করে পৌরসভার চৌধুরীপাড়া, মৌলভীপাড়া, দক্ষিণ জালিয়াপাড়া, লেদা, নেঙ্গরবিল, নাজিরপাড়া, ডেইলপাড়া, শিলবনিয়াপাড়ায়সহ বিভিন্ন এলাকায় আলীশান অট্টালিকা নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েক দিন আগেও এসব বাড়িগুলোতে রঙ্গমঞ্চ চলতো। কিন্তু এখন সব বাবারা পালিয়ে যাওয়ায় বাড়িগুলো খা-খা অবস্থায় পড়ে আছে। এসব ইয়াবা বাবারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছে। তবে বাড়িগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাউকে না পেলেও তারা প্রতিটি বাড়িতে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বা সিসিটিভি স্থাপন করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফের এক ব্যক্তি জানান, টেকনাফের মৌলভীপাড়ায় রাস্তার পূর্বে পাশে বাড়ি বানিয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ী আবদুর রহমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় তিনি অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। এলাকায় সবাই তাকে ‘বাবা’ ওরফে ইয়াবা বাবা নামে চেনেন। মাদকবিরোধী অভিযানের পর তিনি নিজের বাড়িতে অবস্থান না করে অন্য আত্মীয়ের বাড়িতে যাত যাপন করছেন। বিজিবির এক সূত্র জানায়, গত সাত বছরে ইয়াবা ব্যবসা করে আব্দুর রহমান কোটিপতি হয়েছে। তিনি টেকনাফের মৌলভীপাড়ার শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আর তার গ্রামের বাড়ির পেছনে অথাৎ নাফ নদী দিয়ে নৌকা যোগে ইয়াবার চালান আনা হতো। কক্সবাজার, রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিত্যনতুন পদ্ধতিতে ইয়াবাপাচার করতেন। তার ভাই কয়েক বছর আগেও বেকার ছিল। সীমান্ত এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্য গড়ে তিনিও প্রকাশ্যেই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। গত ২০১১ সালের দিকে টেকনাফের এক প্রভাবশালী ইয়াবা গডফাদারের নজরে পড়ে তার ভাই একরাম হোসেন। তারপর থেকে তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তারা নামে-বেনামে শহরে ভবন, জমি, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারসহ বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছে। আর মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর কয়েক মাস আগেই তাদের কাছে খবর প্রকাশ করা হয়েছিল। ফলে জীবন রক্ষার্থে ইয়াবা বাবারা পালিয়ে যায় আত্মগোপনে। ২০১৬ সালের ৮ জুলাই ভোরে টেকনাফ থানার পুলিশের হাতে আটক হয় আবদুর রহমান। এর আগে সে কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের গুলিতে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আটক হন। এরপর আদালত থেকে জামিনে এসে পুনরায় ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসা, হত্যা, হামলা, সরকারি কাজে বাধা, মারপিটসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে। অপরদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই মুজিবুর রহমান, ফয়সাল ও শফিক টেকনাফ এলাকায় রাজকীয় বাড়ি নির্মাণ করেছেন। আর ‘ইয়াবা বাবা’ বদির আরেক ভাই আবদুস শুক্কুর টেকনাফের অলিয়াবাদে অট্টালিয়া বানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি মাদক ব্যবসায়ীদের নতুন ও পুরনো তালিকায় তাদের নাম রয়েছে। টেকনাফের নুরুল হুদা, জোবাইয়ের, নুরুল বশর নুরশাদ, সালমান, হাসান আলী, বদির ফুফাতো ভাই কামরান হাসান রাসেল, নূর মোহাম্মদসহ অনেকের নাম রয়েছে। আর বদির বেয়াই আকতার কামাল ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ায় উল্লিখিত ব্যক্তিরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এসব ইয়াবা বাবাদের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়িগুলো এখন খা খা করছে। টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ইয়াবাসহ মাদক ঠেকাতে বিজিবি কাজ করে যাচ্ছে। সীমান্ত পেরিয়ে ইয়াবার গডফাদাররা যাতে পালাতে না পারে, সে বিষয়েও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রনজিত কুমার বড়ুয়া গতকাল সন্ধ্যায় আমার সংবাদকে জানান, মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর তালিকাভুক্ত ইয়াবা গডফাদাররা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। ইয়াবার টাকায় যারা রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি বানিয়েছে, তাদের বাড়ি, গাড়ি ও ব্যাংক ব্যালেন্সের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা জানান, মাদকবিরোধী চিরুনি অভিযানের পর কক্সবাজার, টেকনাফসহ দেশের বড় বড় মাদকের গডফাদারগণ তাদের আলীশান বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। তবে তারা যেখানে যান না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।