কক্সবাজারে মাদক বিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর অডিও টেপ প্রকাশের পর তোলপাড় চলছে দেশজুড়ে। গত ২৬শে মে রাতে টেকনাফ পৌর কাউন্সিলর একরাম বন্দুকযুদ্ধে মারা যান বলে দাবি করে র্যাব। ওই দিনের ঘটনার সময় রাতে একরামের মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে স্ত্রী ও সন্তানরা কয়েক দফা কথা বলেন। কথিত বন্দুকযুদ্ধের সময়ও একরামের ফোন কলটি সচল ছিল। যা তার স্ত্রীর ফোনে রেকর্ড হয়। বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলন করে একরামের স্ত্রী আয়েশা খাতুন ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
একই সঙ্গে অডিও রেকর্ডের টেপও গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেন। ওই অডিওতে বন্দুকযুদ্ধের ‘ভয়ঙ্কর’ মুহূর্ত সরাসরি উপলব্ধি করেছেন নিহত একরামের স্ত্রী ও দুই কন্যা। সংবাদ সম্মেলনে আয়েশা খাতুন তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন।
এদিকে সংবাদ সম্মেলন করে তথ্য প্রকাশ করলেও বিষয়টি সব গণমাধ্যমে গুরুত্ব পায়নি। কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে তা প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয় দেশজুড়ে। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার সংগঠন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ ঘটনা মাদক বিরোধী অভিযানকে পুরোপুরি প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। এর যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। অডিও প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। এদিকে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই গতকাল র্যাব সদরদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, অডিও ক্লিপটি খতিয়ে দেখছে র্যাব সদর দপ্তর। বিষয়টি তারা তদন্ত করছেন। তদন্ত শেষে এ বিষয়টি নিয়ে খোলাসা করবে র্যাব। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, একরামুলের পরিবারের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা অডিও ক্লিপটি র্যাবের হাতে এসেছে। আমরা সেই ক্লিপটি শুনেছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।
এ ঘটনার বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান গতকাল রাতে বলেন, যখনই বিচারবহির্ভূতভাবে কোনো কিছু করা হয় এবং আইন ভঙ্গ করে যখন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন অনেক সময় নিরীহ মানুষ এর শিকার হতে পারে। একটি মানুষ হাজারটা অপরাধ করতে পারে। সেই অপরাধের জন্য তাকে ধরে প্রথমে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। কারও বিরুদ্ধে ১০ থেকে ২০টা মামলা আছে। মামলা থাকা মানে এই নয় যে, ওই ব্যক্তি অপরাধী। সেই অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হতে হবে। আইনের বিধান হচ্ছে যে, অপরাধী আদালতে অপরাধী প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে নির্দোষ বলতে হবে। আমরা যে তার (একরামের) অডিও টেপটি শুনেছি সেখানে কোনো বন্দুকযুদ্ধের অবকাশ ছিল না। তাহলে কেন তাকে হত্যা করা হলো, কি উদ্দেশ্যে হত্যা করা হলো? এর দায় দায়িত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হবে। একটি মানুষকে ধরে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলবে আর রাষ্ট্র চুপ করে দেখবে এটি হতে পারে না। এ ঘটনাটি রাষ্ট্রকে তদন্ত করে দেখতে হবে। পরিবারের পক্ষ থেকে যে, দাবি করা হয়েছে, এটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার। বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।
যা আছে অডিও টেপে: বৃহস্পতিবার দুই মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে আসেন একরামের স্ত্রী। ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, জমি সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে একরামকে ডেকে নেয়া হয়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তার মোটরসাইকেলে জ্বালানি ছিল না। একরাম তার কাছে টাকা চাওয়ায় তিনি ২০০ টাকা বের করে দিয়েছিলেন। পরে একরাম এ টাকা না নিয়ে পাশের একটি দোকান থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে বের হয়ে যান।
রাত ১১টার পরও তিনি ফিরে না আসায় আমার মেয়ে রাত ১১টা ১৩ মিনিটে তার বাবার মোবাইলে ফোন করে। এ সময় তিনি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে মেয়েকে বলেন, মা আমি হ্নীলা যাচ্ছি। আমি যাদের কাছে এসেছিলাম সেই মেজর সাহেবের সঙ্গে হ্নীলা যাচ্ছি কাজে। এরপর ফোন কেটে যায়। এরপর ১১টা ১৪ মিনিটে আমার মেয়ে আবার ফোন করলে তিনি আবারো কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেন, আমি ইউএনও অফিসে যাচ্ছি। তোমার আম্মুকে বলো। মেয়ে কখন আসবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কাজ শেষে ইনশাল্লাহ ফিরে আসবো।
একরামুল হকের স্ত্রী বলেন, এরপর সর্বশেষ রাত ১১টা ৩২ মিনিটে আবারো ফোন করলে ফোন রিসিভ করেন। কিন্তু এ সময় তিনি আর কথা বলছিলেন না। ওই প্রান্তে আমার স্বামীর সঙ্গে অপরিচিত একটি কণ্ঠের কথা বলতে শোনা যায়। সেই অপরিচিত কণ্ঠে একরামকে বলছেন, তাহলে তুমি জড়িত নও…। আমার স্বামী উত্তর দেন, না আমি জড়িত নই।
এরপরই গুলির আওয়াজ শুনতে পাই এবং আমার স্বামীর আর্তচিৎকার শুনে আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। আমি ও আমার মেয়েরা তাদেরকে চিৎকার করে অনুরোধ করতে থাকি আমার স্বামীকে আপনারা মারিয়েন না, তিনি নির্দোষ। কিন্তু আমাদের কথায় তাদের মন গলেনি। তারা পরপর গুলি করে আমার স্বামীকে হত্যা করে। এমনকি আমার স্বামীকে গুলি করার পর তাদের নিজেদের কথোপকথন আমাদের কানে আসছিল। সেখানে তারা বলছে, এইবার গাড়িতে গুলি কর।
এদিকে একরামুল হককে গুলি করার আগে ও পরে র্যাবের কথোপকথনের অডিও রেকর্ডে শোনা যায়। রাত ১১টা ১৪ মিনিটে একরামের মেয়ে আবারো ফোন করে জানতে চায় তিনি কোথায় আছেন।
অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, আমি টিএনও (ইউএনও) অফিসে যাচ্ছি তো, আমি চলে আসব আম্মা। ফিরতে কতক্ষণ সময় লাগবে- মেয়ের এ জিজ্ঞাসায় অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে, বেশিক্ষণ লাগবে না, আমি চলে আসব ইনশাল্লাহ, ঠিকাছে? ঘুমাও। রাত ১১টা ৩২ মিনিটে আবারো মেয়ে ফোন করলে একরাম বলেন, হ্নীলায় যাচ্ছেন। কেন সেখানে যেতে হচ্ছে জানতে চাইলে উত্তর আসে, তিনি ‘জরুরি কাজে’ যাচ্ছেন। মেয়ে তার কাছে আবারো জানতে চায়- কেন? ধরা গলায় জবাব আসে, যাচ্ছি আম্মু ঠিকাছে, যেতে হচ্ছে।
মেয়ে তখন জানতে চায়, বাবা কাঁদছো কেন?
এই অবস্থায় ফোন নেন আয়েশা। তিনি হ্যালো হ্যালো করতে করতেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে আবার ফোন করেন একরামের স্ত্রী। ফোন রিসিভ হওয়ার আগে তিনি প্রার্থনা করতে থাকেন যেন একবার স্বামীর সঙ্গে কথা হয়। ফোন রিসিভ হলে আয়েশা বলেন, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো কে? হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো আমি কমিশনারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। হ্যালো কে ওইটা, ফোন রিসিভ করছে ওইটা কে? আমি উনার মিসেস বলতেছি, হ্যালো, হ্যালো। এমন সময় ফোনের অপর পাশে কাউকে বলতে শোনা যায় “তুমি যেটা বলছো জড়িত না?
কেউ একজন বলেন, নাহ।
এরপর অগ্নেয়াস্ত্র কক করার শব্দ এবং দুটি গুলির শব্দ শোনা যায়। সেই সঙ্গে মরণাপন্ন কারও চিৎকার। ওই আওয়াজে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন একরামের স্ত্রী ও মেয়েরা।
এ সময় আয়েশা বলেন, ও আল্লা আমার জামাই কিছু করে নাই। আমার জামাই কিছু করে নাই। আমরা বিনা দোষী। আমার জামাই, আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই, আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই। এ সময় ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কয়েকজনের কথা শোনা গেলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। বার বার বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরে গালিগালাজের আওয়াজও শোনা যায়। একপর্যায়ে একরামের স্ত্রী চিৎকার করে জানতে চান- আপনারা কোথায়, আপনারা কোথায়। অপরপ্রান্তে বাঁশির শব্দ বাড়তে থাকে। গালিও শোনা যায়।
কাঁদতে কাঁদতে আয়েশা বলতে থাকেন, আমার জামাই কিছু করে নাই। কমিশনার কিছু করে নাই। আপনারা শুয়ারের বাচ্চা কেন বলতেছেন? উনি কিছু করে নাই। আমার হাজব্যান্ড কিছু করে নাই, কমিশনার কিছু করে নাই, উনাকে কেন মারতাছেন? আপনারা উনাকে কেন মারতাছেন?
অন্য প্রান্ত থেকে কয়েকজনের কণ্ঠ শোনা গেলেও তাদের কথা বোঝা যাচ্ছিল না। কিছু একটা খুঁজে বের করতে কেউ নির্দেশ দেন। এরপর একজন বলেন, বাড়ি কই বাড়ি? এরপর গাড়ির সাইরেনের শব্দ শোনা যায়। পরে আরো তিনটি গুলির শব্দ শোনা যায়, সঙ্গে অকথ্য গালি।
একপর্যায়ে ‘খোসাগুলো’ খোঁজার কথা বলা হয় ফোনের অন্য প্রান্তে। পরে থেমে থেমে বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। একজন বলেন, আর লাগবে না, খোসাগুলো দেখ। ১০ রাউন্ড গুলির কথা বলেন একজন। খোসা খোঁজাখুঁজি করেন। আটটি খোসা খুঁজে পাওয়ার কথা জানান একজন। সাইরেন বাজতে থাকে। আরো খোসা খুঁজে পাওয়ার কথা জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আয়েশা আরো বলেন, ঘটনার পর আমার মেয়ে ও একজন নিকটাত্মীয়কে নিয়ে দৌড়ে থানায় যাই। থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ঘটনা খুলে বললে তিনি নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে আমাদের জানান, একটু আগে মেরিনড্রাইভে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। তাতে একরামুল হক নামে একজন নিহত হয়েছেন।’ এ সময় আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। এরপর দিন আমার স্বামীর লাশ বুঝিয়ে দেয়া হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত একরামুল হকের দুই মেয়ে তাহিয়াত ও নাহিন বিলাপ করছিল। অঝোরে কাঁদেন আয়েশা এবং একরামের বড় ভাই নজরুল ইসলামও। তাদের কান্নায় চোখের পানি আটকে রাখতে পারছিলেন না উপস্থিত সাংবাদিকরাও।