মুসলমানদের সংযম অনুশীলনের মাস রমজান। রোজা রাখলে আত্মিক উন্নতি হয়, পশুপ্রবৃত্তির বিনাশ ঘটে। এজন্যই ইসলাম বছরে এক মাস রোজা রাখাকে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য করেছে। ইসলামের বিধান মেনে আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মানুষ রোজা রাখছেন। কিন্তু রোজার যে প্রকৃত উদ্দেশ্য সংযম সেটা কতটুকু অর্জিত হচ্ছে? রোজার আনুষ্ঠানিকতা পালন হচ্ছে কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অর্জিত হচ্ছে না। আমরা রোজাও রাখছি আবার অসংযমী আচরণও করছি। উপোসও থাকছি আবার রোজাদারের দাবি পরিপন্থী কর্মকাণ্ড করছি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, আমাদের রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জিত হচ্ছে কতটুকু?
রোজার মাস এলে আমাদের অসংযমী আচরণটা প্রকটভাবে ফুটে উঠে। কী খাবো, কী করবো এসব নিয়ে আমাদের মাতামাতির কোনো শেষ থাকে না। আত্মনিয়ন্ত্রণ, পশুপ্রবৃত্তির বিনাশ, পরোপকার, সহানুভূতি এসবই রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য। কিন্তু আমরা সারাদিন না খেয়ে থাকলেও নিজেকে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমাদের পাপাচারী প্রবৃত্তি টেনে নিয়ে যায় সংযম পরিপন্থী বিষয়ের দিকে। কথায় কথায় আমরা রোজার ভাব দেখাই, মেজাজ করি। কারণে অকারণে মানুষের সঙ্গে বাজে আচরণ করি। রোজা রাখার পর কারও মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলে বুঝতে হবে রোজার প্রকৃত শিক্ষা তিনি পাননি। রোজা রেখে আমরা পরচর্চায় অনবরত লিপ্ত থাকি। অথচ এটা রোজার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অন্যের কষ্টের কথা অনুধাবন করা, অন্যের উপকারে আসা রোজার অন্যতম দাবি। কিন্তু আমরা রোজা রেখে কতজনের উপকারে এসেছি! গরিব-দুঃখীদের কষ্টের কথা কতটা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি! আর অন্যায় ও অসততা থেকে আমাদের প্রবৃত্তি কতটা সুরক্ষিত সেটা নিজেরটা নিজেই ভালো বলতে পারব।
সংযমের অনুশীলনের মাধ্যমে বিশ্বাসী বান্দাকে পরবর্তী ১১ মাসের জন্য তৈরি করাই রোজার উদ্দেশ্য। কিন্তু আমরা অনুশীলনের সময়ই সংযম অবলম্বন করি না। রোজার মাস এলে খাই খাই ভাবটা আমাদের মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করে। আমাদের সমাজে একটা কথার প্রচলন আছে, ‘রমজানে যত খুশি খাও এর কোনো হিসাব নেই’। কথাটি কি ইসলামসম্মত? যৌক্তিকভাবেও কি এটা ঠিক? সংযমী জীবনাচারে অভ্যস্থ হওয়ার জন্য যেখানে সিয়ামের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, উপোস থাকার কথা বলা হয়েছে সেখানে ‘যত খুশি খাও’ সেটা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে! ইসলাম ও যুক্তি কোনোটাই এটা সমর্থন করে না।
রোজা এলে আমাদের সব চাহিদাই বেড়ে যায়। এই চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে অনেকে অবৈধ পন্থায় উপার্জনের পথও খুঁজেন। রমজানে আমাদের দেশে ঘুষের বাজার চাঙা হয়ে উঠে। অসততার মাত্রা বেড়ে যায়। সরকারি অফিসের বড় কর্তা থেকে শুরু করে ফুটপাতের একজন সাধারণ ব্যবসায়ীও বাড়তি উপার্জনের চেষ্টায় মেতে উঠেন। যেখানে রমজানে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমে যাওয়ার কথা সেখানে এগুলো আরও বেড়ে যায়। বাহ্যিকভাবে আমরা রোজা রাখছি, ধর্মকর্ম করছি, কিন্তু অবৈধ উপার্জন করতে একটুও কুণ্ঠিত হচ্ছি না। অনেকে উপরে উপরে পাক্কা মুসল্লি, রমজানে সেই মুসল্লিগিরির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখবেন তিনিও রমজানে ‘বাড়তি’ উপার্জন ঠিকই বজায় রেখেছেন।
আনুষ্ঠানিক উপোস থাকার নামই রোজা না, এর কিছু অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে। রোজার দ্বারা আত্মার বিকাশ হয়। অন্তরের কালিমা দূর হয়। মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। ইসলামে রোজা ফরজ করা হয়েছে সমাজের দুঃস্থ ও অবহেলিত মানুষদের কষ্টের কথা অনুধাবন করার জন্য। যাদের প্রতিদিনই কাটে রোজার মতো না খেয়ে তাদের কষ্টটা ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য। কিন্তু সেই দিকে আমাদের কতজনের খেয়াল আছে? রমজানে গরিব-দুঃখীর পাশে যেভাবে দাঁড়ানোর কথা কতটুকু দাঁড়াচ্ছি? রমজানে কেউ কেউ হাঁকডাক করে নামমাত্র টাকা আর কাপড় গরিবদের মধ্যে বিতরণ করেন। কিন্তু সেখানেও থাকে লৌকিকতা, দানবীর হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করার ঘৃণ্য মানসিকতা।
রোজায় অসংযমী ভাবটা বেশি চোখে পড়ে ঈদকে কেন্দ্র করে। রোজার ঈদ মানেই নতুন জামা-কাপড়। ঈদের শপিং শুরু হয়ে যায় রোজার শুরু থেকেই। অনেকে রোজার আগেই ঈদের কেনাকাটা সেরে নেন। কেউ কেউ কেনাকাটা করতে দেশের বাইরেও চলে যান। ঈদকেন্দ্রিক কেনাকাটার মাত্রা দেখলে বোঝার উপায় নেই আমাদের কোনো আর্থিক টানাপোড়েন আছে। এলিট শ্রেণি থেকে নিয়ে ছিন্নমূল মানুষদের পর্যন্ত ঈদকেন্দ্রিক মাতামাতি চোখে পড়ে। ঈদকে কেন্দ্র করে অনেকে এতটাই লাগামহীন হয়ে পড়েন যে, সারা মাস সংযমের রোজার কোনো মূল্যই থাকে না তাদের কাছে। আবার অনেকের কাছে রোজাটা মুখ্য নয়, ঈদটাই আসল। হয়ত একটি রোজাও রাখেননি কিন্তু ঈদ নিয়ে তার মাতামাতির শেষ নেই। যদিও ঈদ হলো রোজাদারদের জন্য। যারা সারা মাস রোজা রাখেন তাদের পুরস্কারের মুহূর্ত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে ঈদুল ফিতরকে।
রমজানের এক মাস সিয়াম মূলত মুসলমানদের অনুশীলনের জন্য। এই মাসে আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম, পরোপকার, সহানুভূতি, পশুপ্রবৃত্তির দমন এসব বিষয় চর্চা হয়। এই শিক্ষা বছরের বাকি দিনগুলোতেও যেন ধরে রাখতে পারে সে তাগিদই দিয়ে যায় রমজান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমরা রমজানের আনুষ্ঠানিকতা পালন করি বটে, এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, মহান শিক্ষা ধারণ করি না। এজন্য রমজান মাস আমাদের জীবনে পরিবর্তনের কোনো ছাপ রেখে যেতে পারে না। রমজান গেলে আমরা যেই সেই হয়ে যাই। এভাবে জীবনের অনেক রমজান কাটিয়েছি, কিন্তু প্রকৃত মুমিন হওয়া তো দূরের কথা প্রকৃত মানুষও হতে পারিনি। এবারের রমজানে আসুন আমরা প্রকৃত মুমিন হতে না পারি, অন্তত প্রকৃত মানুষ হই। রমজানের শিক্ষা ধারণ করে মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করি।